Thursday, January 25, 2024


 কেন হুব্বা?


তন্ময় দত্তগুপ্ত


১৯৮৩ সাল।তপন থিয়েটারে রমমিয়ে চলছে 'নাগপাশ' নাটক।পরিচালনা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়।বাণিজ্যিক থিয়েটারে চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর প্রথম নাটক।নাটকের মূল বিষয়--- রাজনৈতিক নেতারা কিভাবে অভাবপীড়িত যুবকদের সমাজবিরোধীতে রূপান্তরিত করে।ওই নাটকে একটা সংলাপ ছিল---' যাদের কথায় তোমরা লাশ ফেলছ,তারা কাজ ফুরালে তোমাদের লাশ সবার আগে ফেলে দেবে।  প্রকৃতপক্ষে কেউ লুম্পেন হয়ে জন্মায় না।পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে।কারোর আবার প্রবৃত্তি তাকে বিপথে চালিত করে।ব্রাত্য বসুর হুব্বা ছবি দেখে মনে হলো হুব্বা বিমলের পরিস্থিতির তুলনায় কুপ্রবৃত্তির তাড়নাই প্রবল।পরীক্ষার হলে মাস্টারমশাই তার টুকলি ধরার ফলে সে  মাস্টারমশাইয়ের  যে হাল করল তাকে প্রবৃত্তির প্রভাব ছাড়া আর কি বা বলতে পারি!এখানে গ্রীক ট্র্যাজেডি বা নেমেসিসের কোনও পরিচয় নেই।হুব্বা বিমল ওরফে শ্যামল নিয়ে মিডিয়ার চর্চা এখন তুঙ্গে।

একদিন হঠাৎ টিভির পরদায় দেখলাম হুব্বাকে।তখন লাল জমানা।একরাশ বাইকে করে হুব্বা  নমিনেশন জমা দিতে এসেছে।স্মৃতি এখনও টাটকা।আমার পরিবারের সবাই বলেছিলঃ ছি ছি।এতটা অধঃপতন?পরে হুব্বার নমিনেশন ক্যান্সেল করেছিল ইলেকশন কমিশনার।ব্যস ওইটুকুই।হুব্বাকে নিয়ে আলোচনার পদবাচ্য মনে করিনি।হুব্বা,হাত কাটা দিলীপ,কান কাটা হুলো---এদের নিয়ে উচ্চারণ মানে সময়ের অপচয়।তার মানে কি এই গ্যাংস্টারদের নিয়ে ছবি হবে না?রামগোপাল বর্মার সরকার,বা আব তক ছাপ্পন(ওনার প্রোডাকশন কোম্পানীর ছবি।)-তো গ্যাংস্টার নিয়ে ছবি।রামগোপালের প্রথম ছবি 'শিবা' নিঃসন্দেহে ট্রেণ্ড সেটার।বা যদি অগ্নিপথের বিজয় দীনানাথ চৌহানের কথা বলি; তাহলেও মনের আনাচে কানাচে একটা আবেগ বা সেন্টিমেন্ট কাজ করে।কিন্তু হুব্বা দেখে কোনও সেন্টিমেন্ট কাজ করল না।কারণ  এ চরিত্রের উল্লেখযোগ্য কোনও সুপ্রবৃত্তি  তেমন নজরেই এলো না।ব্রাত্য বসুর প্রথম ছবি "রাস্তা" দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।প্রতিটা চরিত্র  এখনও কণ্ঠস্থ।তেমনই মিঠুন রজতাভর অনবদ্য অভিনয়।তেমনই হিট ডায়লগ--- 'লাদেন লাদেন'।


  হুব্বা কেমন? তা নিয়ে হুব্বার গ্রামে যায় বাস্তবের এক টিভি সাংবাদিক।প্রত্যেকেই হুব্বার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।হুব্বা গরীবের উপকার করত।বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত।শুধু তাই নয়,খুব আস্তে আস্তে কথা বলত।সুতরাং হুগলির ত্রাস যে হুব্বা;সে কথা আবার তার গ্রামের মানুষজন বলছেন না।রিল লাইফের হুব্বা কিন্তু অনেক নৃশংস।যৌনতা যার আরেক সঙ্গী।নারীসঙ্গে যার প্রবল আসক্তি।তার মানে একথা বলার কোনও  মানেই হয় না,যে বাস্তবের হুব্বা আজ কা রবিনহুড।অপরাধী অপরাধীই।সে যে আমলের হোক।বিশেষ করে যার মজ্জায় মজ্জায় অপরাধের বিষ। 

হুব্বা সিনেমার কাহিনী বিস্তারিত বলছি না।শুধু এটুকুই বলছি;এক পুলিশ  দিবাকর হুব্বাকে ধরবার জন্য মরিয়া।কিন্তু হুব্বাকে ধরা মশকিলই নেহি না মুমকিন।বিভিন্ন আন্ডার ওয়ারল্ডের নির্ভর সিনেমার সংলাপ সে বলে।অবশেষে পুলিশের জালেই হুব্বার অন্তিম পরিণতি।যে রাজনৈতিক নেতা হুব্বাকে ব্যবহার করেছিল;সেই সোচ্চার হয়ে বলে--- আমাদের পার্টি সমাজ বিরোধীদের প্রশ্রয় দেয় না।প্রশ্ন হলো, হত্যা তো হত্যাই।

তাকে রাজনৈতিক হত্যা বললে তার স্টেটাস কি বাড়ে?যুগে যুগে এমন হত্যা রয়েছে।রাজনীতির আড়ালে যে সমাজ বিরোধীরা দাপিয়ে বেড়ায়,সে কথা আজ কাটা ঘায়ের মতো সত্য।মানুষ খুনের রাজনীতি মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। তাহলে কি সুভাষচন্দ্রের মতো সহিংস নেতারা ভুল ছিলেন? একেবারে নয়।যে দেশে শক হুণ দল পাঠান মোগল এক দেহে লীন হয়;সে দেশেই হুব্বা শ্যামল,হাতকাটা হুলো,তাজা বোমার মতো মাস্তানের জন্ম দেয় মহান নেতারা।হয়তো কদিন বাদে শুনতে হবে---তুমি আমাকে দুর্নীতি করার অধিকার দাও,আমি তোমাকে অর্থ,নিরাপত্তা সব দেবো।ব্রাত্য বসুর অরণ্যদেব নাটকের একটা সংলাপ --- অটল বিহারী কি রবীন্দ্রনাথের কনটেম্পরারি?ব্রাত্য হয়ত অনেক  এগিয়েই ভেবেছিলেন।সে সময় কি চলে এলো? সত্যি এ বড় দুঃসময়।ভয়ের ভারসাম্যহীন জীবনে আমাদের শিরদাঁড়া অজান্তেই হারিয়ে যায়। 

হুব্বা ছবিতে সৌমিক হালদারের ক্যামেরা খুবই ভালো।প্রথম শট মনমুগ্ধকর।ড্রোন ক্যামেরায় পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠা এবং হুব্বার অস্পষ্ট লাশের ভেসে বেড়ানো।হুব্বার চরিত্রে মুসারফ করিম অনেক প্রশংসা পেয়েছেন ইতিমধ্যে।এবং তার কমিক টাইমিং নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সে নিয়ে আর আলোচনা করছি না।তবে ক্লোজ শটে করিম সাহেব তার অভিব্যক্তিকে আর একটু সংযত করতে পারতেন।তাতে রিয়ালিস্টিক অভিনয় বোধহয় আরেকটু ভালো হতে পারত।আমার কেন জানি না বাস্তবের হুব্বার  দৈহিক গঠনের দিকে তাকিয়ে বার বার খরাজ মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ছিল।খরাজ এই চরিত্রে অভিনয় করলে নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতেন।সকলেই ভালো অভিনয় করেছেন।বিশেষ করে পুলিশের চরিত্রে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত।মার্জিত অভিব্যক্তি।একটা দৃশ্যের কথা উল্লেখ না করে পারছি না।হুব্বার দ্বিতীয় নারীর প্রতি আসক্তি এবং ইন্সপেক্টরের দ্বিতীয় প্রেমের প্রচ্ছন্ন আভাসের যে সেতুবন্ধন তা অনবদ্য।ছবির মুডের সঙ্গে আবহও সঙ্গীত মানানসই।


ফ্ল্যাশব্যাক এবং সমকালীন ট্রিটমেন্ট-এর ব্যাপারে কতটা পরিচালকের বক্তব্য ছিল আর কতটা সম্পাদক সংলাপ ভৌমিকের নিজস্ব সৃজনশীলতা ছিল--- সেটা এই সামান্য লেখকের পক্ষে বলা কঠিন।কারণ ছবির একটা পর্যায়ে অতীত ও সমকাল ভিন্নভাবে উপস্থাপিত।শুধু একটা বিষয় কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না।কেন নির্দিষ্ট ভাবে হুব্বা শ্যামল পরিচালক ব্রাত্য বসুর সিলেবাসে এলো? 



No comments:

Post a Comment