Saturday, February 12, 2011

প্র্সঙ্গ তখন তেইশ

সমালোচনা করুন; শুধু শিল্পীর নয়,-শিল্পের, গ্রাহকের, রস পরিবেশনের ও গ্রহণের ৷ সমালোচনা সরাসরি টাকা এনে দেয় না ৷ সোজাসুজি ভালো  ছবির জন্ম  দেয় না বা তাকে চালায় না, কিন্তু শিল্পীমন এরই জন্য আকুল হয়ে থাকে ৷ সব শিল্পী নিজের ওজন করতে চায় ৷ পেলে, এমনকি রূঢ়ভাবে পেলেও, খোরাক সংগ্রহ করে আরো এগোনোর ৷ এটাই সমালোচন৷র গুপ্ত কথা ৷  
                                                                                                                           ঋত্বিক ঘটক


                                                   প্র্সঙ্গ তখন তেইশ

সার্থক সিনেমা শুধুমাত্র রূপালী পর্দার চতুষ্কোণে আবদ্ধ থাকে না ৷ উপচে পড়ে পর্দার বাইরে। অন্য আবেদন তৈরী করে। যে আবেদন অস্থির দোলাচলে  আপাত স্থিতাবস্থা বজায় রাখে। এই দোলাচল দেহ ও মনের। বাইরের ও ভেতরের। উন্নত প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত এই প্রজন্মের মনোপরিসরে প্রভাব ফেলছে। বদলে যাচ্ছে দেখার চোখ । জীবনধারার বৈশিষ্ট্য ।এই নিরিখে "তখন তেইশ" আধুনিক সময়ের ছবি।আবার একই সঙ্গে সময়কে  অতিক্রম করার প্রয়াস।উত্তরকালকে স্পর্শ করার ইঙ্গিত।আর এখানেই ঘটে যেতে পারে বা পারত একটা বিস্ফোরণ।

এ ছবির টেক্সট বা বয়ান বহু আলোচিত।বহু চর্চিত। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে প্রেসিডেন্সি বা অন্যান্য অলি-গলি-পাকস্থলির ভেতর। যৌবনে বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে পুরুষমনে কামকল্পনা অচেনা নয়।এই কামনার প্রশমন বাস্তব সভ্য সমাজে কিঞ্চিত রাখ-ঢাক-গুর-গুর বলেই কাম নিয়ে এত কল্পনা। এত স্বপ্ন-ফানুস। প্রসঙ্গক্রমে একটি বিশেষ উক্তির কথা ঝিলিক মারছে । ঝিলিক মারছে মনে। রবীন্দ্রনাথ তার ভ্রাতুস্পুত্রী ইন্দিরাকে চিঠিতে লিখেছিলেন---- যাকে আমরা প্রবৃওি বলি এবং যার প্রতি আমরা সর্বদাই কটু ভাষা প্রয়োগ করি সে আমাদের জীবনের গতিশক্তি---- সেই আমাদের নানা সুখ-দুঃখ পাপ পুণ্যের মধ্যে দিয়ে আনন্দের দিকে বিকশিত করে তুলছে । ... আমাদের  সর্বদাইএকটা মস্ত বড় ভুল হয় যে, আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের যেখানে নিয়ে এসেছে সেইখানে বুঝি ছেড়ে দিয়ে   চলে যাবে, আমরা তখন জানতে পারি নে সে আমাদের তার মধ্যে থেকে টেনে তুলবে। নদীকে যে শক্তি মরুভূমির মধ্যে নিয়ে আসে সেই শক্তিই সমুদ্রের মধ্যে নিয়ে যায় । এইরকম করেই আমরা চলছি। যার এই প্রবৃত্তি বা জীবনশক্তির প্রাবল্য নেই, যার মনের রহস্যময় বিচিত্র বিকাশ নেই, সে সুখী হতে পারে ,সাধু হতে পারে এবং তার সেই সংকীর্ণতাকে লোকে মনের জোর বলতে পারে, কিন্তু অনন্ত জীবনের পাথেয় তার বেশী নেই।

তখন তেইশ-এর মুখ্য চরিএ তমোদীপ এই প্রবৃত্তির দাস ।অন্যান্য যুবকের সঙ্গে তমোদীপের প্রবৃত্তির প্রকরণগত প্রভেদ রয়েছে অনেকটাই । তমোদীপের কামনা বাসনা কখনই কেবল স্খলনের বার্তা দেয় না । লাইফ লাইন নার্সিংহোমের চিকিৎসক হয়েও তমোদীপের লাইফলাইন মালায়লম নীলছবির নায়িকা মোহিনী । মাননীয় পাঠক লক্ষ্য করবেন প্রদীপ প্রেক্ষাগৃহে মোহিনীর নীল হাতছানির ক্রিয়ায় তমোদীপের প্রতিক্রিয়া এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া অন্তর্মুখী । পাশাপাশি রয়েছে আবেগপ্রবণ মানবিক দিক । যে কারণে মানস-কল্পনার সময় সে বাস্তবে শিউরে ওঠে । পর্দার যৌন নিগ্রহ তার মানসীকে পীড়া দেয় ।  সেই মোহিনী দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভর্তি হয় লাইফ লাইন নার্সিংহোমে । কী আশ্চর্য নিয়তির নিয়ন্ত্রণ । কল্পনার মোহিনী এখন বাস্তবে । পুলিশি জেরায় মোহিনী বলে তার আসল নাম--- শম্পা দাশগুপ্ত ।  তমোদীপের অভিব্যক্তিতে প্রশ্নবোধক-বিস্ময় --- আপনি মোহিনী নন ???!!! মোহিনী বলে --দুটোই । ফ্যান্টাসির চরিএ বাস্তবে । শম্পা বাস্তবের জল হাওয়ায় লালিত  অনাথআশ্রমে পালিত এক চরিত্র । আর মোহিনী তমোদীপের মানসী । স্বপ্ন-কল্পনা । বাস্তব আর স্বপ্নের মধ্যবর্তী কোনো স্তর ।  বাস্তবে দুমিনিট স্বপ্নে বহুক্ষণ--- এমন ধরণের ।  নার্সিংহোমে বাস্তবের  শম্পা দাশগুপ্ত-কে কেন্দ্র করে স্বপ্নের মোহিনীর সঙ্গে চুম্বন দৃশ্য যেন আশ্রয় বনস্পতি । দৃশ্যের সঙ্গে সুসামঞ্জস্য রেখে ভয়েজওভারে মালায়লম সংলাপ দক্ষ সিনেমাটিক প্রয়োগ । প্রমাণ করে মোহিনী ও শম্পা এক হয়েও এক নয় । ভিন্ন সওা ।শম্পা আর তমোদীপের কথা থেকে জানা যায় নীলছবির মোহিনীর দেহ সত্যি, কণ্ঠ ও সংলাপ অন্য কারোর । ডাবিং । শিকড়হীন প্রতিভাময়ী শম্পা (আবৃওি, সঙ্গীতে সম্ভাবনাময়ী) কেন নীলছবির সিংহভাগ জুড়ে??? তার স্পষ্ট কারণ পরিচালক দেননি । তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না । তার তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ  সন্দীপনের মুখে সেই জরুরী প্রয়োজনীয় সংলাপ--- তুমি যেটা করছ তাকে কি কোনোভাবে শিল্প বলা যায়? পর্ণোগ্রাফি কি শিল্প ? এ প্রশ্ন শুধু ওই দুই চরিত্রের উদ্দেশ্যে নয় । আমাদের সকলকে । যে সমাজে পর্ণোগ্রাফির চাহিদা রয়েছে সেই সমাজকেও । প্রণম্য পাঠক এখানে কিন্তু ভালো-মন্দ, ঠিক-ভুল, উচিত-অনুচিতের কথা আসছে না । ভাবনার প্রসারণ ঘটছে মাত্র । ভোগবাদী পণ্যসর্বস্ব সমাজের চলতি ধারণা--- যারা বহু ব্যবহৃতা তারা বুঝি সহজলভ্য ।  নার্সিংহোমের " ক্লাসফোর স্টাফ" ননী ও তার সঙ্গীর লোলুপ দৃষ্টি থেকে রেহাই পায়নি মোহিনীর দেহজ আকর্ষণ । পরিচালক অতনুর ভাষায় এরা "ক্লাসফোর স্টাফ।"ফোর্থ ক্লাস স্টাফ নয় । অনুসঙ্গ হিসেবে ফ্ল্যাশব্যাকের একটি পরিচিত ছবি মৃণাল সেন পরিচালিত খারিজ । মুক্তিকাল---১৯৮২ । স্মৃতির ভরসায় বলি গ্রাম থেকে আসা বাড়ির ভৃত্যকে মৃণাল বাবু বলেছিলেন---- কাজের মানুষ । কাজের লোক নন।অর্থাৎ নিম্নবিও মানুষের শ্রেণী অবস্থান খাটো করে না দেখে শ্রমের মর্য্যাদা অনুযায়ী বিচার করাই শ্রেয় । পরিচালক অতনু ঘোষ তর্জনী তুলে ভালো-খারাপ নির্দিষ্ট করেননি । ক্লাসফোর স্টাফ-এর সংলাপেই তার অভিরুচি-অভিপ্রায় স্পষ্ট --- রাতে ঘুমোলে আমরা এক এক করে আসব । আর এখানেই সকলের অলক্ষ্যে ঘটে যাচ্ছে এক শব্দ-সাংস্কৃতিক বদল । প্রবীণ চিকিৎসক (বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়)-এর সংলাপ অত্যন্ত ক্যাজুয়াল অথচ চরিত্রের ব্যক্তিত্ব গঠনে সুউপযুক্ত-- কথা বল গল্প কর প্রয়োজনে লাইন মারো কিন্তু ঘুম পাড়িয়ে দায়িত্ব খালাস কোরো না ।এখানেই স্বল্পপরিসরে  পরিচালকের মন্ত্রমুগ্ধ ডিটেলিং ।

লাইফলাইন বা জীবনদায়ী নার্সিংহোম ক্রমেই মোহিনীর কাছে নরক যন্ত্রনার উপক্রম হয়ে উঠবে--- এমন প্রত্যাশা ছিল তমোদীপের । তাই প্রচলিত নিয়মের বাইরে বেরিয়ে অভিনব উপায়ে মোহিনীর উদ্ধারকার্যের পরিকল্পনা করে সে ।তখনই প্রয়োজন পড়ে তৃতীয় ব্যক্তির । সে শ্রীপর্ণা । তমোদীপের চ্যাট ফ্রেণ্ড বা ফেসবুক বন্ধু । যার পরিচয় আমরা আগেই পেয়েছি । শ্রীপর্ণা একাকীত্ব মোচনের জন্য  চ্যাট করে । চ্যাট করা আর চ্যাটফ্রেণ্ড মিট করা । "সিন বিটউইন দ্যা সিন" ভাবা যেতে পারে প্রথমে চ্যাটিং ছিল "জাস্ট ফর টাইম পাস" । কিন্তু সময়ের সঙ্গে 

সঙ্গে তা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে । আর এখন সেটা অ্যাডভেঞ্চার । আবার শুধু রোমাঞ্চ বললে চরিত্রের প্রতি সুবিচার করা হবে না । বিদগ্ধ পাঠক ও দর্শক দেখলে বোঝা যায় শ্রীপর্ণার দৃশ্য-উপস্থিতি (Screen Presence) একবারের জন্য নেতিবাচক মনে হয়নি । বহু মানুষকে সাক্ষাৎ করা যেন তার প্রকৃত মানুষকেই খুঁজে বেড়ান । মানুষ পড়া । তার চ্যাটিং "জাস্ট ফর ফান" হলে তমোদীপের কাছে  সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত না । কিংবা বিডনস্ট্রীটের বাড়িতে অন্ধকারে সন্দীপনের শারীরিক আহ্বানে আপত্তি থাকত না । বরং তার উপস্থিত বুদ্ধি তারিফ যোগ্য । যা মুহূর্তেই সন্দীপনকে দূরে সরিয়ে রাখে ।প্রণম্য পাঠক সন্দীপনের (রজতাভ দত্ত) চরিত্র বিশ্লেষণের জন্য ব্যতিক্রমী পরিসর প্রয়োজন । সন্দীপনকে নিয়ে এক সম্পূর্ণ রচনা । এ লেখা আপনাদের সামান্য দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তবেই সন্দীপনকে নিয়ে অন্য অধ্যায় শুরু করব । শুধু এটুকু বলি সন্দীপন বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে কৌতুহলী ও জটিল চরিত্র । এক জটিল মনস্তত্ব ।

মূল সুরে ফিরে আসা যাক ।তমোদীপ শ্রীপর্ণার সাহায্যে গোপনে শম্পা ওরফে মোহিনীকে নার্সিংহোম থেকে সরিয়ে দিয়েছে । গাড়িতে হঠাৎ শ্রীপর্ণা লক্ষ্য করে শম্পা ভ্যানিশ । শম্পা দাশগুপ্ত কি হারিয়ে গেল ??? হারিয়ে গেল  নীল ছবির জগতে ??? নাকি আবার সন্দীপনের নিয়ন্ত্রণাধীন যৌন উপাদান মাত্র । চরিত্রটা এখানে শেষ হতে পারত । কিন্তু হয়নি । কেন হয়নি সে প্রসঙ্গে পরে আসছি ।

                                                                      
                                                              তখন ১৭


তমোদীপের জীবনে আরও দুই নারী । মা শ্রাবণী ও শিক্ষিকা মেঘনা । বয়ঃসন্ধিক্ষণে শিক্ষিকার প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক । রাজকাপুর পরিচালিত "মেরা নাম জোকার"-এর প্রথম পর্ব তার উজ্জ্বল উদাহরণ ।মুক্তিকাল--- ১৯৭০ । লক্ষ্য করবেন ওই ছবিতে শিক্ষিকার প্রতি আকর্ষণের উৎসপথ ছিল দেহ । বা এক ধরণের যৌন-চুম্বক আকর্ষণ । তমোদীপ আর মেঘনার সম্পর্ক তেমন নয় । একই সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে চলে আসছে বাৎসল্য এবং শৃঙ্গার । বাৎসল্য প্রকট  শৃঙ্গার প্রচ্ছন্ন । বিশেষ করে মার পরেই অপর নারী একইসঙ্গে সঙ্গিনীর মাঝে "ফ্রেণ্ড ফিলোসাফার গাইডকেই" খুঁজে পাওয়া । মেঘনা তমোদীপের জীবনে তেমনই । আর পাঁচজন মায়ের মতই শ্রাবণীর চোখে তমোদীপ- মেঘনার সম্পর্কের এই মাহাত্ম্য ধরা পড়েনি । মার সিদ্ধান্তে তমোদীপের জীবন থেকে সরে গেছে মেঘনা । নৈকট্যে যেমন সম্পর্ক সতেজ থাকে তমনই দূরত্বেও সম্পর্ক সজীব থাকে । অন্যদিকে মার সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছে তমোদীপ । কিন্তু মনে নেয়নি । ব্যবধান তাই বেড়েছে ।

                                                              তখন ২৩

প্রায় ছ-বছর । বদলেছে মার মনোভাব । মেঘনার সঙ্গে  তমোদীপের পূর্বের সম্পর্ক না ফিরলে মা-ছেলের সম্পর্ক মেঘমুক্ত হবেনা । এমনই ধারণা  শ্রাবণীর ।

তমোদীপের জন্মের কিছু পরে দাদু বলেছিল ---- এ ছেলে হয়  শিল্পী হবে নয় বাড়ি ছেড়ে পালাবে । মানুষ কখন পালায়??? এক অন্তহীন প্রশ্ন তাড়া করে বেড়ায় তমোদীপকে । তাড়া করে বেড়ায়  এক জীবন থেকে অন্য জীবনে । আবার সেই প্রশ্ন ---  মানুষ কখন পালায়??? মেঘনা বলে --- ফ্যান্টাসির সব কটা দরজা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন মানুষ  পালাতে চায় ।

                                                    একটি গুরত্বপূর্ণ দৃশ্য

তমোদীপের জীবনে নতুন গাড়ি । খানিকটা স্বপ্নের মত । সেই গাড়ি আরক্ত-অনন্য । তমোদীপের ইচ্ছায় মা খুলে দেয় সেই গাড়ির দরজা । যেন গত প্রজন্ম স্বাগত জানাচ্ছে এই প্রজন্মকে । উভয় প্রজন্মের ধারণার প্রতি উভয় প্রজন্ম শ্রদ্ধাশীল । পাশাপাশি মাতৃত্বের অমোঘ আকর্ষণ । তবু বলব মাননীয় দর্শক উভয় প্রজন্মের ধারণার মধ্যে ঊনিশ-বিশ পার্থক্য-তো থাকবেই । সেটাই কাঙ্খিত । আর তাই গাড়ির ভেতরে তমোদীপ । বাইরে মা । উভয়ের হাত স্পর্শ করতে চাইছে উভয়কে । কিন্তু করছে না । মাঝে স্বচ্ছ কাঁচ । স্বচ্ছ সম্পর্কের মত । আবার এই দৃশ্যের অন্য একটা ব্যাখ্যা হতে পারে । গাড়ির এপাড়ে মা বাস্তবের মাটিতে । আর ওপাড়ে তমোদীপের নিজস্ব জগৎ । বাস্তব জগতের কোলাহল বর্জিত স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যবর্তী স্তর । আর তাইতো মার সঙ্গে মিলিত  হওয়ার পরও এক অস্পর্শা দূরত্ব । তখন তেইশ-এর উৎসাহব্যঞ্জক জায়গা এখানেই । পরতে পরতে বহুস্তরের জন্ম হচ্ছে । সে গাড়ি চালিয়ে তমোদীপ এগিয়ে যায় অনির্দিষ্ট কোনো গন্তব্যে । পথে কালো পোশাক পরিহিতা মোহিনী । মোহিনী না শম্পা দাশগুপ্ত !!! ??? পূর্বের সেই প্রশ্নবোধক বিস্ময় ???!!!


                                              তখন ২৭ বা পরিচালকের চোখ

তমোদীপ এখন সাতাশ । সাতাশতম জন্মদিন তার । আর এখন সে পৌছে গেছে স্থির অটুট উপলব্ধির অন্তিমবিন্দুতে । আমাদের চারপাশে আজ অজস্র ফ্যান্টাসি ।   ফ্যান্টাসির জানালা খুললেই কি দেখা যায় উন্মুক্ত মনের আকাশ ? নাকি সেই ফ্যান্টাসির আকৃতি-প্রকৃতি প্রযুক্তির পর্দায় আচ্ছন্ন ??? আধুনিক প্রযুক্তি কম্পিউটারের ভি জি এ প্যানেলের থেকে জীবন-প্রকৃতির রং অনেক অনেক বেশি । মোর দ্যান সিক্সটিন মিলিয়ান কালারস্ । এই অসংখ্য অপরিচিত রঙের সংস্পর্শ পেলে মনের ক্যানভাসে ফুটে উঠবে ছবি । মূর্ত-বিমূর্ত ছবি । তাহলেই শিল্পী ।জীবন শিল্পী । সাতাশতম জন্মদিনে বহির্জগত যখন সংযোগ-সাধনে ব্যর্থ তখন তমোদীপ অন্য রাজ্যে । নিজস্ব মনগড়া মনোজগতে । সঙ্গে  সাদা পোশাক পরিহিতা মনের মানসী । মুহূর্তে মানসী পরিবর্তিত হয় শম্পায় । যখন সে বলছে --- তোমার মোবাইল সুইচ অফ দেখে মেঘনা আমার মোবাইলে এস. এম. এস করেছে - Life is calling switch on your mobile. তমোদীপ তাকায় । চোখে-মুখে প্রত্যয় । তমোদীপের দাদু
বলেছিলেন তমোদীপের চোখ দুটো অন্যরকম । সেই অন্যরকম চোখ পেয়েছে সে ঠিকই । তবে আর পাঁচজনের মত দৈনন্দিন জীবন গ্রহণ করেও সে বিরল-ব্যতিক্রম । তাই ভয়েজওভারে সেই মূল্যবান মতামত--- " ঠিক তখনই বৃষ্টি এল যখন মনের ভেতরটা ভালো করে দেখা হয়ে গেছে । কোথাও কোনো অস্থিরতা ভয় অনুতাপ বা লজ্জা জমা হয়ে নেই ।  চারদিকে শুধু ছড়িয়ে আছে রং । কম্পিউটারে ভি জি এ প্যানেলের চেয়েও অনেক বেশি । মোর দ্যান সিক্সটিন মিলিয়ান কালারস্ । শুধু একটা তুলি আর ক্যানভাস হাতে পেলেই আমার আর্টিস্ট হত্তয়া কে আটকায় ।

                                                  সুখীগৃহকোণ আছে গ্রামোফোন

 প্রতাখ্যাত শম্পা ফিরে আসে  অচেনা মেঘনার দরজায় । দুই নারী হয়ে উঠল একে অপরের পরিপূরক । মেধাবী দৃশ্য নির্মাণ সন্দেহ নেই । কিন্তু চিন্তার তরঙ্গের তিন নারীর (শম্পা,শ্রীপর্ণা,মেঘনা) নির্দিষ্ট বিন্দুতে মিলিত হওয়া , তমোদীপের সহকর্মীর সঙ্গে  নার্সের চারহাত এক হওয়া সহজ সমীকরণ বলে মনে হয় । অবশ্য বাঙালী সেণ্টিমেণ্ট চিরকালই পয়ারে বিশ্বাসী । অমিত্রাক্ষরে নয় । আর পরিচালক--তো দিনের শেষে সমাজবদ্ধ জীব । তাই স্বপরিবারে দেখার ছবি তখন তেইশ ।


                              
                                বিন্যাস- দৃশ্যবিভাজন- সম্পাদনা- পোশাক-অভিনয়

ছবিটি তিন সময়ে সংযুক্ত । তখন ২৩,   তখন ১৭, ও তখন ২৭ । পরিচালক  অতনু গল্প বলেছেন অথচ গল্প বলার ফর্ম বদলে । এখানেই অতনুর তুখোর বুদ্ধি প্রখর মুন্সিয়ানা । ঘটনার পরম্পরা মেনে তখন তেইশ এগোলে হোঁচট খেত । শ্লথ হত সিনেমার গতিপথ । এ ব্যাপারে আর একজনের নাম অনস্বীকার্য । সম্পাদক সুজয় দত্ত রায় । ইন্টারকাটিং এ ছবির গুরুত্বপূর্ণ মূলধন । মুহূর্তেই ছবির গতি বাড়িয়ে দিয়েছে । স্থান এবং কাল (Time and Space)- এর বাঁধন উন্মুক্ত করে অতনু-সুজয় যুগলবন্দী নতুন স্টাইল তৈরী করেছে। ন্যরেটিভ অথচ লিনিয়ার ন্যারেটিভ নয় । বলা যেতে পারে ব্রোকেন ন্যারেটিভ । দৃশ্যবিভাজন ও পরিকল্পনা পরিচ্ছন্ন । একটি দৃশ্যবিভাজন ও পরিকল্পনা না বললেই নয় । নলবনের সেই দৃশ্য । যেখানে পরিবেশ পরিস্থিতিকে প্রতিষ্ঠিত করার পর তমোদীপ-শ্রীপর্ণাকে ক্যামেরার ধরা । আর শেষ দৃশ্য ??? বলাই বাহুল্য এক সম্পূর্ণ দৃশ্যকাব্য । শৌমিক হালদারের চিত্রগ্রহণ যেন ক্যানভাসে রং-তুলির কারুকার্য । এবার আসি পোশাক পরিকল্পনায় । সুচ্ছন্দা এ ব্যাপারে প্রশংসার যোগ্য । আহত মোহিনীর নীল শাড়ি যে নীল ছবির প্রতীকী রূপ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।  নীলরঙের তাৎপর্য বহুবিধ । ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়ার্ডস অনুযায়ী ১৮২৪ সালে স্কটিশ গ্যালোয়িডিয়ান এনসাইক্লোপেডিয়ার ভাষায় নীলরঙের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য "Lewd" বা লিউড । যার অর্থ নীচ, কামুক, অসৎ চরিত্র ইত্যাদি । স্বাভাবিক প্রশ্ন-- নীলরঙের এমন ভাবার্থ কেন???  স্কটল্যাণ্ডের বেশ্যাবৃত্তিতে বন্দী মহিলারা নীল গাউন পরত । ভেবে দেখুন পাঠক মোহিনীর জীবন চর্চার একাংশের সঙ্গে নীলরঙের সাদৃশ্য অনেকটাই । এ ধারার ছবিকে নীলছবির বলার আর একটা ইতিহাস আছে । ১৮৭১ সালে স্যামুয়েল 
পিটারস প্রকাশিত "History of Connecticut"- গ্রন্থে  এর বিবরণ আছে পরিষ্কার ভাবে । বলপূর্বক আদিম বর্বরোচিত কাজকে পিটারস বলেছিলেন "Bloody law"বা "Blue law" । এখান থেকে BLUE FILM-er নামকরণ বলে অনেকের ধারণা । অতীত  ইতিহাসে নীলছবিকে সর্বস্তরের সমাজে তির্যক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হত । 

অভিনয় প্রসঙ্গে বলব যীশুর তমোদীপ বিশ্বাসযোগ্য । চমৎকার অভিব্যক্তি । বিশেষ করে সায়লেণ্ট  এ্যাক্টিং-এ যীশুর জুড়িমেলা ভার । ওর বডিল্যাঙ্গুয়েজে স্পষ্ট আগামী অভিব্যক্তির আভাস । পাওলির মোহিনী ও শম্পা বিভাজিত । অস্থিরচিও, পরস্পর বিরোধী মনোভাব পাওলির অভিনয়ে উজ্জ্বল । যেমনটি পরিচালক চেয়েছিলেন । শম্পার চরিত্রের গঠন, সংলাপ  দর্শক আনুকূল্যের পক্ষে যথেষ্ট । এ ব্যাপারে পরিচালকের কৃতিত্ব অনেকটাই । আর বলব মেঘনার কথা । ইন্দ্রাণী হালদারের অভিনয় উচ্চতা বর্ণনা করার মত ভাষা আমার অভিধানে নেই । বাদ বাকিরা চরিত্র উপযোগী।

                                      

                                           ছোট্ট জিজ্ঞাসা

জীবনের রং কম্পিউটারের ভি জি এ প্যানেল থেকে অনেক বেশী ।অর্থাৎ Life is larger than technology । অবার সেই প্রযুক্তির সাহায্যে "Life is calling switch on your mobile" বলার কারণ বোধোগম্য হল না । ওই আন্তর্জাতিক মানের দৃশ্যের রং , কম্পোজিশান , ক্যামেরা অপারেশন যে জীবনের আহ্বান,তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । তাহলে কি ওই দুই জীবনের মধ্যে তারতম্য রয়েছে ??? একজীবন তমোদীপের অন্তর্জগৎও অন্যটি বহির্জগৎ?নাকি অন্তর্জগত ও বহির্জগতের মধ্যে সেতু রচনা করেছে অতনু ?                 
                           তখন আমি বা একটি কাল্পনিক উপাখ্যান

জার্মান নাট্যতাত্ত্বিক ব্রেখ্ট বলেছিলেন মঞ্চ অভিনেতাকে একই সঙ্গে সজাগ ও বিযুক্ত থাকতে হবে । দর্শকের ক্ষেত্রে যদি তত্ত্বটি প্রয়োগ করা যায় তাহলে কেমন হবে ??? তখন তেইশ-এর দর্শক আসনে ব্রেখট্ থাকলে কি বলতেন ??? সজাগ এবং বিযুক্তিকরণের কোনো তত্ত্ব কি খাটত ??? তবে এই প্রথম । সর্বপ্রথম আমি সম্পূর্ণ বিশ্লেষণী হতে পারলাম না । মার্জনা করবেন পাঠক । তাই এবার নিজস্ব আবেগের কিছু কথা---------


                                                          Playing with the cloud
                                                          Flashes lightning loud
                                                          Want to listen the story?
                                                         Yea it"s your-our memory
                                                         Rain touches the soft skin
                                                       Beckon us a nostalgic green


তখন তেইশ সেই নস্টালজিয়া । আমার মনের মানচিত্রে অমলিন ।