Thursday, February 2, 2023

 তিন চরিত্র অচেনা পৃথিবী

তন্ময় দত্ত গুপ্ত


১০ এর মধ্যে এই ছবিটাকে কত নাম্বার দেওয়া যায় বলুন তো? 

সবে সেদিন বিয়ে হয়েছে।সাত দিন যেতে না যেতেই স্বামী চম্পট।আপনি কী করবেন?প্রথম সন্দেহ---নিশ্চয়ই স্বামীর আগের প্রেমিকার সাথে ইন্টু মিন্টু কেস?পাকা দেখার পর কতই না স্বপ্ন।পাড়ার পাঞ্চালী বলেছিল--- "বিন্দাস ব্যাপার তো রে।ছেলের লণ্ডনে চাকরি।মফস্বলের মেয়ে আংরেজি বাবু"।গত রাতেই আমার হাতে করা ধোকার তরকারি খেলো।আর আজ সকালেই ধোকা দিয়ে টাটা গুডবাই।সাত দিনে সেক্স হল  কতবার?love হল কি!মুহূর্তেই আপনার কাছে জুটে গেল প্রচলিত ওয়েল উইশার। এক ডালি সম্ভাবনা  নিয়ে।তারপর পুলিশে ডায়েরি।

ফরমুলা বাংলা ছবি এর ধারে কাছ দিয়ে যাবে হয়তো ।নয়তো হঠাৎ এক গোয়েন্দার আগমন ঘটবে।শুরু হবে টান টান রহস্যে ভরপুর স্বপন কুমারের গল্প।ব্যস জমে খিচুড়ি।কিন্তু সেই মেয়েটি যদি  সঞ্চিত সামান্য টাকা নিয়ে ডেসপারেটলি লণ্ডনে পাড়ি দেয়!পরিচিত ঝাঁ চকচকে লণ্ডনের ভেতরে আবিষ্কার করে ফেলে আরেক লণ্ডন!তখন আপনারা এমন ছবিকে কি বলবেন? এতকালের ধ্যান ধারণার বাইরে যে অভিঘাত তৈরী হবে,তা সংশয়হীন স্বতন্ত্র।।অতনু ঘোষের "আরো এক পৃথিবী" এই সংশয়হীন স্বতন্ত্র ছবির গোত্রের।অতনু ঘোষের বিশ্ব সিনেমার চোখ অত্যন্ত শক্তিশালী।

তাই বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে চরিত্রের সম্পর্ক এবং আবেগের সংলাপ দীর্ঘস্থায়ী নয়।একটা পরিমিতির ওপর নির্ভরশীল।যেমন অ্যাবি সেনে অ্যাবি টাইম মেশিনে  আশির দশকে ফিরে গিয়েই শাশুড়িকে বলে দেয়,সে একবিংশ শতাব্দীর মানুষ।সম্পর্কের এই রহস্যকে দীর্ঘায়িত করা যেত।ইচ্ছাকৃ্তই অতনু তা করেননি।

প্রতীক্ষাঃ তাসনিয়া ফারিণ


আরো এক পৃথিবীও তাই।প্রতীক্ষা (তাসনিয়া ফারিণ) তার  স্বামী অরিত্র(সাহেব ভট্টাচার্য)-র  কাছে লণ্ডনে যায়।তার অনুসন্ধানের মধ্যে টিপিক্যাল বাঙালি নারী মনস্তত্বর প্রভাব নেই ।নেই নারীবাদী প্রতিবাদ।আছে অজানাকে জানার ইচ্ছে।অরিত্র (সাহেব ভট্টাচার্য)-র দৃশ্য  উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত কম।মৃণাল সেনের 'এক দিন অচানক'-এর সেই অধ্যাপক কোথায় হারিয়ে গেলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।।তার চলে যাওয়ার পর পারিবারিক মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে আমাদের মনোজগতে  ভাবনার অবয়ব নির্মিত।আমাদের রক ইউনিভার্সিটির মতানুসারে ওটা আঁতেল ছবি কিন্তু  'আরো এক পৃথিবী'তা নয়। 

                                                            

শ্রীকান্ত মুন্সিঃ কৌশিক গাঙ্গুলী

লন্ডনের  গৃহহীন মানুষ যে আমাদের দেশীয় ছিন্নমূলের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন;তা তো প্রতীক্ষার চোখ দিয়েই আমরা জানলাম।পার্কের বেহালা বাদক শ্রীকান্ত মুন্সি(কৌশিক গাঙ্গুলী) প্রবল  অপ্রত্যাশিত চরিত্র।সে হেমিংওয়ে আওড়ায় ---'A Man can be destroyed but not defeated'.আবার এই হেমিংওয়ে নিজেই নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করে।এটা কি নিছকই আত্মহত্যা?নাকি মৃত্যুর ভেতর জীবন খোঁজা?শ্রীকান্ত নৌকাবাসী।স্বেচ্ছায় চার দেওয়ালের বাইরে গৃহহীন।পথ হারাবে বলেই সে পথে নেমেছে।কারণ সোজা পথে কোনও ধাঁধা নেই।আছে ছক বাঁধা জীবন।তার সংলাপেই  ভাগ্নি  নুড়ির কথা উঠে আসে ।নুড়ি কি শ্রীকান্তর অবচেতন?বাস্তবের চরিত্র নাকি আবেগের কনসেপ্ট?আরেক চরিত্র আয়েষা (অনিন্দিতা বোস)।

আয়েষার ভাষায় সে  স্টুডেন্ট কাউন্সিলার।সে কি শুধুই স্টুডেন্ট কাউন্সিলার?আমাদের সন্দিগ্ধ মন আবার প্রশ্ন করে।এই পেশার সঙ্গে অন্য কোনও পেশায় কি সে যুক্ত?অরিত্র-কে ঘিরেও নানান ধারণা তৈরী হয়।স্বার্থপর প্রতারক নাকি পরিস্থিতির শিকার?সেই সঙ্গে আমরাও অতনু ঘোষের অতীতের টেলিফিলম অঙ্কুশের সাথে মেলানোর চেষ্টা করি।'আরো এক পৃথিবী'-র অরিত্র আর প্রতীক্ষার প্রণয় পরিণতি আমাদের মন গড়া ভাবনার সাথে কোনও ভাবেই মেলে না। 

ছবির  পরতে পরতে রহস্য।তবে সাসপেন্স থ্রিলার বলতে আমরা  যেমন বুঝি, তেমন নয়। Human psychology-র মতো অপ্রত্যাশিত চমক আর কিছু আছে নাকি?শেক্সপিরিয় ট্র্যাজেডির মতো পরিস্থিতি এবং কার্যকারণ অনুযায়ী কাহিনী এগিয়েছে।এখানে প্লট বেশি গুরুত্বপূর্ণ।প্রতীক্ষার কাহিনীর মধ্যে খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরোক্ষে অতনু ঝটিকা সফরের মতো রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বুনে দিয়েছেন।প্রতীক্ষার বাবা(সৌমিত্র) এবং মা(স্বাতী)-র  সম্পর্ক, দুটি পাখি দুটি তীরের মতো।মাঝে যে নদী সেই নদীর নাম তিতাস নয়।প্রতীক্ষা। 

অরিত্র,আয়েষা,শ্রীকান্ত এই বিরোধী বিন্দু কিভাবে এক স্রোতে মিলিত হোল--- সেটাই দেখার।এবার আসছি অভিনয় বিশ্লেষণে।প্রথমেই বলি শ্রীকান্তর কথা।কৌশিক গাঙ্গুলীর শ্রীকান্ত কখনও স্বাভাবিক কখনও অস্বাভাবিক কখনও হিংস্র কখনও শান্ত।কখনও চূড়ান্ত রোমান্টিক।আমার এই উক্তিতে পণ্ডিতেরা প্রশ্ন করতেই পারেন --- ভাই এখানে রোমান্টিসিজম পেলেন কোথায়?শ্রীকান্ত বিশ্ব সাহিত্যের একেকটা উক্তি যখন আমাদের সামনে তুলে ধরছে বা বেহালা বাজাচ্ছে তখন আমার তাকে রোমান্টিকই মনে হয়েছে।হিউমার,উইট,সারকাসম,স্যাটায়ার তার চরিত্রে  মিশেছে।শ্রীকান্ত দৃঢ় ভাবে যখন বলছে --- ''আই এ্যাম নট বেগার' তখন চাবুকের মতো বুকে বাজে।আমাদের এখানে ট্রেনে গান গেয়ে অর্থ উপার্জন করা ভিক্ষা বৃত্তি।আর লণ্ডনে সেটাই ক্রিয়েশন এবং পেশা---'মাঝে মাঝে সত্তর পাউণ্ড হয়ে যায়'।বাবা মায়ের দূরত্ব ও পরিবেশের প্রভাবে প্রতীক্ষা  অন্তর্মুখী।সেই দিকে তাসনিয়া   ১০০ শতাংশ সফল।সাহেব ভট্টাচার্যের অরিত্র খুবই পরিণত।এর আগে সাহেব-কে এমন দায়িত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখিনি। 

অরিত্রঃ সাহেব


আয়েষার ভূমিকায় অনিন্দিতা অনবদ্য।কিছু কিছু মুখশ্রী থাকে জন্মগত অভিব্যক্তি পূর্ণ।অনিন্দিতার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,চোখের ভাষা সংলাপের আগেই ভীষণ ভাবে মনে প্রভাব ফেলে।আপ্পু প্রভাকরের ক্যামেরা; দক্ষতার সঙ্গে তাকে ধরেছে।অনিন্দিতা সামনাসামনি অতটা মোহময়ী নন;যতটা পরদায়।

আয়েষার ভূমিকায় অনিন্দিতা বোস

ছবির বিষয়ে বিষন্নতা আছে বলেই লো লাইটে বেশি ভাগ শুটিং।কালার টোনেও তাই।ক্যামেরার হ্যাণ্ড হেল্ড অপারেশনের যে নান্দনিক সৌন্দর্য;তা এখানে যথাযথ।প্রতীক্ষার চোখ দিয়েই তো আমরা অন্য লণ্ডনকে খুঁজছি।তাই ক্যামেরার চোখ,প্রতীক্ষার চোখ এবং দর্শকের চোখ একাকার হয়ে গেছে।সুজয় দত্ত রায়ের  সম্পাদনায় বিশ্বমানের একটা ম্যাচকাট আছে।ফলে প্রতীক্ষার ঘটমান বর্তমানএবং ভাবনা; মুহূর্তেই ছিন্ন হয়েছে।আমার কাছে এ পৃথিবী নতুন।ধন্যবাদ পরিচালক অতনু ঘোষ।