Monday, April 17, 2023

                          অতনুর পাতা

                                                   তন্ময় দত্তগুপ্ত 

সঞ্জয় লীলা বানসালির ব্ল্যাক ছবির একটি দৃশ্যের কথা উল্লেখ না করে পারছি না।মূক ও অন্ধ মিশেলকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না।তখন ওর টিচার বলেছিলেন --- "উসে এক টিচার নেহি ম্যাজেশিয়ান কি জরুরত হ্যায়।" "শেষ পাতা" দেখার পর অবলীলায় সেই সংলাপ আমার নিজস্ব কথা হয়ে উঠল।বাংলায় অন্য ধারার সিনেমার এই ম্যাজেশিয়ানের নাম পরিচালক অতনু ঘোষ।আপনাদের মনে হতেই পারে আমি বাড়াবাড়ি করছি!জোর গলায় বলছি--- না।একদম না।শেষ পাতা দেখলেই বুঝবেন বাল্মীকি সেনগুপ্ত অন্য প্রসেনজিত।প্রসেনজিতের অভিনয়ের পুনর্জন্ম বললেও অত্যুক্তি হবে না।

এতদিনে সবাই ছবির বিষয় জেনে গেছেন।ময়দানে বাল্মীকির স্ত্রী রোশনির নগ্ন লাশ পাওয়া যায়।কারা যেন তাকে কুপিয়ে খুন করে।অতনুর ময়ুরাক্ষীর মতো রোশনি এখানে "অফ দ্যা ক্যারেক্টার"।বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে রোশনি চরিত্র। স্ত্রী রোশনি বসুর অকাল প্রয়াণে বাল্মীকির অন্তর্জগত যেন বলে ওঠে-- "দীপ নিভে গেছে মম"।এই রবীন্দ্রগান ছবির কোনও অংশে নেই।বাল্মীকির অন্তর্জাগতিক অবস্থান বোঝানোর জন্য এই গানের কলির ব্যবহার।


 
বাল্মীকির ভূমিকায় প্রসেনজিতঃস্মৃতির সন্ধানে 





বাল্মীকি যে বহিরাবণে রত্নাকরে পরিণত হয়েছে,তা তার উগ্র বহিঃপ্রকাশে বুঝতে পারি।অন্তরে একটা শৈল্পিক সত্তা,আবেগপ্রবণ মন; মাঝেমধ্যে চলকে ওঠে।একার সঙ্গে একার লড়াইয়ে নয়।মেধার (অভিনয়ে গার্গী রায়চৌধুরী) মেধাবী সংস্পর্শে।এক প্রকাশনী সংস্থা বাল্মীকিকে মোটা টাকা ধার  দেয়।তার মৃত স্ত্রীর খুন বিষয়ে লেখার জন্য।বাল্মীকি লিখব লিখব করে লেখে না।আর তা উদ্ধার করার জন্য আসে রিকভারি এজেন্ট শৌনক(বিক্রম)।সেই সূত্রেই আসে মেধা।এরা বাল্মীকির জীবনের শেষ পাতা উদ্ধার করতে চায়?তারা কি পারবে?না পারবে না?ঘটনার এই মূল সূত্র ধরে কাহিনীর শাখা প্রশাখা বাড়ে।সেই সঙ্গে বাড়ে চরিত্র।কলকাতার পুরানো ভাড়া বাড়িতে একাধিক ভাড়াটে, ও কাজের মাসি।আর আসে বাল্মীকির এক ম্যাসেজের মহিলা।সে কি শুধুই বাল্মীকিকে ম্যাসেজের সেবা দেয়?নাকি আরো কিছু...?  বাল্মীকির মতো চরিত্র আমরা আগেও পড়েছি।আবার হয়তো বা দেখেছিও।তাহলে এ ছবির মাহাত্ম্য কোথায়?মাহাত্ম্য; আবেগ যুক্তির সংযত পরিশীলিত প্রয়োগে।এখানেই পরিচালকের মেধা।আমার ব্যক্তিগত ধারণা "শেষ পাতা" অভিনয় প্রধান ছবি।চিত্রনাট্যের অবশ্যই প্রাধান্য রয়েছে। 

এ ছবিতে ইণ্ডোরের তুলনায় আউটডোরের সংখ্যা কম।প্রথম দৃশ্য আউটডোরে, ময়দানের মাঠে।বাল্মীকির হেঁটে আসা এবং মাঠের ঘাস ছেঁড়ার পর মাটিকে স্পর্শ করা।ওই মাটির অংশেই কি পড়েছিল খুন হওয়া স্ত্রী রোশনি বসুর নগ্ন লাশ?মহেশ ভাটের "সারাংশের" শেষ দৃশ্যে মৃত পুত্রের ছাই থেকে পার্কের মাঠে চারা জন্মেছিল।এক আশার আলোয় পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।"শেষ পাতা" ঠিক তার বিপরীত অনুভূতি তৈরী করে।এক নস্টালজিক নৈরাশ্য তৈরী করে বাল্মীকির দৃষ্টিকোণে।তার মধ্যেও অতীতকে জাপটে বাঁচার কী নিদারুণ সুখ ও যন্ত্রণা মিশ্রিত। 
এই মাটিকেই স্পর্শ করে বাল্মীকি  





 






এ লেখা লিখতে লিখেতে বহুকালের দুটো পুরোনো পঙক্তি মনে পড়ল--- কষ্টেও এক সুখ আছে হয় যদি তা খাঁটি/বদলাতে পারে এ পৃথিবীর আকাশ বাতাস মাটি।অন্যান্য ছবি দেখে আমরা বলি --- গুরু বুম্বা দা(প্রসেনজিত) কী অভিনয় করেছে!সত্যি বলছি ,এই ছবিতে আমার মনে হয়েছে আমি আপাদমস্তক বাল্মীকি সেনগুপ্তকে দেখছি।অভিনেতা যখন আমার "আমিকে" এ্যাকশান থেকে কাট পর্যন্ত কিছুটা বিসর্জন দিয়ে চরিত্রের "আমি" হয়ে ওঠে,তখন সেই চরিত্রই প্রাণময় ও জীবন্ত হয়।অনেক পরে কোন্ অভিনেতা সেটা অভিনয় করলেন,আমাদের মনে আসে।ছবির সঙ্গে দর্শক একাত্ম হলে তবেই এমন সম্ভব। 

বাল্মীকির পাশাপাশি শৌনকের কথা বলব।শৌনকের চরিত্রে বিক্রমের রিয়ালিস্টিক অভিনয় আবার প্রমাণ করে--- 'ফিলম ইস আ ডিরেক্টরস মিডিয়া'।পরিচালক সঠিক হলে ম্যাজিক সম্ভব।মেধার চরিত্রে গার্গী রায় চৌধুরী অনবদ্য।কিছু দৃশ্যের উল্লেখ করছি ।মেসেজের মহিলা বাল্মীকির সামনে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মেধার অভিব্যক্তি বদলে যায়।হালকা ভুরু কুচকানো আর চোখের ভাষাই এখানে সংগত।সংলাপ নিস্প্রয়োজন।অন্যদিকে শৌনকের সঙ্গে কথোপকথনের সময় মেধার অভিব্যক্তি বদলে যায়।শৌনক অনেক আস্থাশীল মেধার কাছে।অভিব্যক্তি তাই বলে। বৈবাহিক জীবনে বিপর্যস্ত মেধার মনচিত্র আবার আরেক রকম।

মেধার ভূমিকায় গার্গী রায়চৌধুরীর অভিব্যক্তি 




শৌনকের প্রেমিকার ভূমিকায় রায়তি ভট্টাচার্যকে আমি প্রথম দেখলাম।দূরবীন দূরত্বে সামনা সামনি দু একবার দেখেছি।কথাও শুনেছি।রায়তির অরিজিন কি ওপার বাংলায়?ওর বাস্তবের কথায় একটা টান আছে।কিন্তু শেষ পাতায় দেখলাম সে সব মুহূর্তেই ভ্যানিস।মধ্যবিত্তের প্রেম,আর্থিক সংকট,  রসিকতা, সারল্য পূর্ণ মাত্রায় দীপার চরিত্রে প্রকাশিত।দীপার শৌনকের উদ্দেশ্যে সংলাপ --- "প্লিজ রাগ কোরো না"।অনেকদিন পর সিলভারস্ক্রীনে এই প্রেম দেখলাম। 





 ও হ্যা আরেকটা দৃশ্যের কথা বলতেই হচ্ছে --- বৃষ্টি ভেজা মদ্যপ অবস্থায় কাদামাখা পাঞ্জাবি পাজামা পরিহিত বাল্মীকিকে দেখে চমকে গেলাম।অতনু একবারো দেখালেন না বাল্মীকি বাইরে বেরিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে বা তার অন্য কিছু হয়েছে।কিন্তু অনুচ্চারিত দৃশ্য বলে দিলো হয়তো তেমনটাই ঘটেছে।বাল্মীকির পাজামা পাঞ্জাবি খোলানোর সময় পরিচালকের মুন্সিয়ানা দেখে আবার অবাক হলাম।আপনারা প্রত্যেকেই জানেন প্রসেনজিতের ব্যায়াম করা চেহারা।বাল্মীকির জরাজীর্ণ অবহেলিত যে দৈহিক গড়ন হওয়ার কথা তা প্রসেনজিতের একেবারেই নেই।এক্ষেত্রে পরিচালক প্রসেনজিতের ততটুকুই শারীরিক অংশই নিয়েছেন যতটুকু প্রয়োজন।তা না হলে বাল্মীকি আর প্রসেনজিত ভিন্ন সত্তা হতো। আর ধিন তাকের ব্যাটা তিন তাক...ইতিমধ্যেই ট্রেলার আর সোসাল মিডিয়ার দৌলতে জনপ্রিয় হয়েছে। "শেষ পাতা" অনুভূতির অন্তিম তন্ত্রীকে স্পর্শ করেছে বলেই আলাদা করে সম্পাদনা, চিত্রগ্রহনের কথা বললাম না।অবশ্যই দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গীত পরিচালনা, প্রশংসার দাবী রাখে।

আমি জানিনা এই তৃষ্ণার্ত অমার্জনীয় রোদ্দুরে কেন নন্দনের মতো হলে ১-৪৫-এ "শেষ পাতার" শো?কর্তৃপক্ষ মহাশয়/মহাশয়া আমাদের মতো সিনেমাপাগলের ওই সময় যেতে কোনও আপত্তি নেই।কিন্তু সান্সস্ট্রোক হলে আমাদের শেষ পাতা কে লিখবেন বলুন তো? 

 বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ পড়েছি কেউ কেউ প্রসেনজিতের অন্যান্য ছবির সঙ্গে এই ছবিকে এক সারিতে বসাচ্ছেন!আসলে ক্ষীর আর খিচুড়িকে এক করে দিলে আস্ত একটা বকচ্ছপ হবে।তেমনটা করবেন না প্লিজ।