Saturday, April 30, 2011

শ্রদ্ধার্ঘ্য ২৫ শে বৈশাখ


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
                                
                   আন্তর্জাতিকতায় রবীন্দ্রনাথ
                              তন্ময় দত্তগুপ্ত

বর্ষণ-মুখর সন্ধ্যা । বৃষ্টির গতি প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে ।গৃহের ভেতর অসংখ্য বিজলি বাতি। কিন্তু নেই বিজলি। জানালার কপাট বন্ধ । যত্সামান্য ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বয়ে আসছে বাতাস । বাইরের ঝড়ের দাপট সেদিন ছিল এমনই । অন্দরমহল-এর সাধ্য ছিল না তাকে রোখার । টেবিলের ওপর মোমের নরম শান্ত আলো মাঝে-মধ্যেই কেঁপে-কেঁপে উঠছে । যেন কিছু একটা ঘটবে ।  তারই পূর্ব ইঙ্গিত । একি পৃথিবীর উত্তাল রূপ ? না কি শান্ত-স্নিগ্ধ জীবনের প্রাকমুহূর্ত !!!??? এমনই এক ঝড়- জলের পরিবেশে নষ্টনীড়ের অমলের আগমণ ঘটেছিল  চারু আর ভূপতির অন্দরমহলে।আর এমনই ঝর-ঝর মুখর বাদল দিনে রবীন্দ্রনাথের লেখনীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার। তখন নিতান্তই শৈশব।  আর পাঁচজনের মতো রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে এলেন বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের
মাধ্যমে ।এলেন শিক্ষক-শিক্ষিকা,অভিভাবক-এর হাত ধরে । তাই  সেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনুভূতির নির্যাসের সঙ্গে একাকার হয়ে   যান নি।  কারণ বিশ্বকবিকে আমরা দেখেছিলাম অপরের চোখ দিয়ে । শৈশব থেকে পরিণত প্রাপ্তমনস্কের দিকে যত আমরা এগিয়েছি ততই বিস্মিত হয়েছে মন। উপলব্ধির অন্তিম তন্ত্রী সোচ্চার অথচ নীরব ভঙ্গিমায় বলেছে -- আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে ...  শৈশবে তাকে পেয়েছি নির্দিষ্ট সীমানায় । কৈশোরের সীমানা পেরিয়ে স্বদেশ ভাবনায় তিনি ততটাই সাবলীল । আর যৌবনে !!!প্রত্যেক প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তস্থলে রবীন্দ্রনাথ । যৌবনে যখন কোনো রমনী বা যুবতীর আরক্ত কপোল খেয়াল করেছি তখনও মনের প্রতিবিম্বে ভেসে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ --- হৃদয় আমার নাচিরে আজকে ময়ূরের মতো নাচিরে কিংবা যে ছিল আমার স্বপন চারিণী তারে বুঝিতে পারিনি।  কখনো সখী ভাবনা কাহারে বলে সখী যাতনা কাহারে বলে .... এই প্রথম প্রেম-কে প্রশ্ন করতে শেখালেন রবীন্দ্রনাথ। যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি খানিকটা কাব্যিক অভিব্যক্তি --- শান্তিও না /ক্লান্তিও না /বেদনাও নয় /সুখও নয় /মনের মধ্যে একটা কিছু হচ্ছে /জানিনা কি নাম ?/ কি নাম তার? /দেহে কি সন্ধ্যা নামা ভালো !!!/ অথবা মনে অন্ধকার !!!/ কানের মধ্যে দিয়ে / মনের মধ্যে /রোম থেকে শিরায় /শিরা থকে উপশিরায় /ধমনীর তাজা রক্তে সাঁতরে বেড়াই/ জানিনা কি নাম ???!!!!/কি নাম তার ????!!!!/ অপরিচিতা অপরাজিতা ।আজ আর নেই কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব।   নেই একচিলতে মেঘ।একদম পরিছন্ন আকাশ । সেই কোন সুদূর অতীত থেকে রবীন্দ্রনাথ দেশ কাল সীমার বেড়াজাল অতিক্রম করে হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক ।


রবীন্দ্র-জীবনের উত্স বিন্দু অত্যন্ত  সহজ সরল সাবলীল  এবং স্বচ্ছ । বলাই বাহুল্য, বাংলার ১২৬৮-র ২৫-শে বৈশাখ জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম হয় কবিগুরুর । কবির জীবনের উত্সমুখ যতটা সহজ ততটা সহজ নয়  তার প্রতিভার গতিময়তা । তার প্রতিভার নানা মোড় নানা বাঁক।কখনো চড়াই কখনো বা উতরাই । তার প্রতিভার শাখা-প্রশাখা বহু ব্যাপ্ত বহু বিস্তৃত । বাল্যবেলায় রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ থাকতেন বাইরে ।রবিকে থাকতে হত ভৃত্যের অধীনে । ভৃত্য মহলের  শাসনে কাটত তার সারা বেলা ।কিন্তু মন চলে যেত জানালার বাইরে দূর দিগন্তে । স্মৃতি যতটুকু অনুমোদন করে সেই নিরিখে বলা যায়, জল পরে পাতা নড়ে --- এটাই ছিল কিশোর রবির জীবনে আদি কবির প্রথম কবিতা । বাল্যবেলায় আরও একটি ছড়ার কথা জানা যায় যা ছোট্ট রবির মনে এনেছিল বৃষ্টি প্রবাহ -- বৃষ্টি পরে  টাপুর টুপুর /নদেয় এল বাণ । প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত দার্শনিক  বার্টণ্ড রাসল-এর উদ্ধৃতি । রাসল চিরকাল একা থাকার  শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন । তিনি বলেছেন সব শিশুকে একা ঘরে বন্ধ করে রেখে তাকে একাকিত্বে অভ্যস্ত  করলে তার ব্যক্তিত্ব প্রবল ভাবে গড়ে উঠবে । একা যে মানুষ থাকতে ভালবাসে না, তার মনুষত্য প্রায় অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অর্থাৎ শিশু মন-মস্তিস্ক প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে অপরিণত। অনেকটা মাটির ড্যালার মতো। সেই মন বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক করলে বাইরের পরিবেশের প্রভাবে আহত হতে পারে । সুতরাং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিশুর প্রয়োজন  নিজেকে বোঝার ।এই উপলব্ধি সম্ভব একমাত্র একাকিত্বেই ।নিজেকে জানা-বোঝার মাধ্যমেই পরিপার্শ্ব বোঝা । এই বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের গানে চমত্কার ভাবে প্রকাশিত --- আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা । রাসেলের একাকিত্ব  এবং শৈশব সম্পর্কে মন্তব্য রবীন্দ্র জীবন ও শৈশবে  যথাযথ  উপায়ে প্রযোজ্য । একাকিত্ব থেকেই রবীন্দ্র সৃজনশীলতার জন্ম ।বহুর মাঝে থেকেও তিনি ছিলেন একা ।আবার তিনি পেরেছিলেন একের বিরহ -কে  সমগ্রের এবং একের বিচ্ছিন্নতাকে সমষ্ঠির  করে তুলতে। আবার লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রবীন্দ্র চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মার্কসীয় দর্শন ও ভাবধারার আশ্চর্য যোগসূত্র । মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের  মূল কথা হল---প্রতিটি বস্তুর মধ্যে দুই বিপরীত উপাদানের সহবাস রয়েছে ।পরিষ্কার করে  বলা যায় , কৃষির ক্ষেত্রে-- ফসল ফলা মানেই ফসল কাটার সময় আসন্ন । আবার ফসল কাটা মানেই বীজ বপণের প্রস্তুতিপর্ব । আবার অর্থনীতির ক্ষেত্রে -- কোনো কিছু উত্পাদন করা হয় ভোগ করার জন্য । আবার ভোগের পর উত্পাদনের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যিক । জীবনের  ক্ষেত্রেও একথা বলা যায় --- পিতা পুত্রের জন্ম দেয়।পুত্র প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে আবার সন্তানের জন্ম দেয় । অর্থাৎ আবার পুত্র পিতায় রূপান্তরিত হচ্ছে । প্রকৃতি, সমাজ, জীবন এই perpetual order বা অনন্ত ঘূর্ণন প্রক্রিয়ায় আবর্তিত ।রবীন্দ্রসঙ্গগীতে এই দৃষ্টান্ত বহুরূপে বহুভাবে উজ্জ্বল । অসীমকালে যে হিল্লোলে জোঁয়ার-ভাঁটায় ভূবন দোলে  কিংবা নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু দোলে ভালে -- এই দুটি সঙ্গীতে জীবনের দুই দিক প্রকাশিত। জোঁয়ার-ভাঁটা , জন্ম-মৃত্যু একই মুদ্রার দুই পিঠ । একটি ব্যতীত অন্যটি অচল । সেই সূত্র ধরেই বলা যায় অন্য একটি ঘটনার কথা । ছোট বৌঠান কাদম্বরীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ছাদে একা একা পায়চারী করতেন ।আর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতেন --- "তুমি কোথায় বৌঠান , একবার এসে আমায় দেখা দেবে না !!! সেই সময় কবি গাইতেন একটি গান --- " আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো "। নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে উপরিউক্ত গানটির সঙ্গে আইজ্যাক নিউটনের  তৃতীয়  গতি সূত্রের  অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক । নিউটন বলেছিলেন -- every action is an opposite and equal reaction . অর্থাৎ প্রত্যেক ক্রিয়ার-ই একটি সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে ।আমরা যদি কাদম্বরীর মৃত্যুকে একটি নেতিবাচক ক্রিয়া বা negative force হিসেবে বিশ্লেষণ করি তবে তার বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বা  positive action হল কাদম্বরীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের এই সঙ্গীত । কবির শোক, হতাশা , ক্ষোভ অভিমান রূপান্তরিত হচ্ছে  সঙ্গীতে । ব্যক্তিগত যন্ত্রনা থেকে নিহিত  এই সৃজনশীলতার ভ্রূণ ।এ ধরণের আবেগের প্রশমণকে গ্রীক দার্শনিক আরিস্তোতল তার পোয়েটিক্স  গ্রন্থে বলেছেন ক্যাথারসিস ।রবীন্দ্রনাথের আর একটি সঙ্গীতে আমরা পাই মার্কসীয় দর্শন ও নিউটনের সূত্র ---- "অন্ধকারের উত্স হতে উত্সারিত আলো ।" অন্ধকারের গর্ভ ভেদ কোরে আলোর উত্সারণ । রবীন্দ্র-উত্তর  কবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় পাওয়া যায় তেমনই ইঙ্গিত --- " তুমি অন্ধকারকে ভয় পাও / মাতৃগহ্বর !! সেও তো অন্ধকার /তবে কেন ভ্রান্তের কুটীরে বাস । মাতৃ গর্ভে শিশু  থাকে দশ মাস দশ দিন। পরে শিশু অন্ধকারের গর্ভ ভেদ কোরে সন্ধান পায় আলোর । প্রসঙ্গত বলা যায় এক ফরাসী পরিচালকের  কথা ।তিনি বলেছিলেন --- চলচ্চিত্র হলো পজিটিভএবং নেগেটিভের  মিশ্রণ । আমরা যখন ছবি তুলি তখন তা থাকে কালো বা নেগেটিভ । ল্যাবোরটারিতে সেই নেগেটিভ ছবির  শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে পসিটিভ ছবির জন্ম খানিকটা অন্ধকারের উত্স হতে উত্সারিত আলোরই রূপান্তর ।মৃত্যুশোক রবীন্দ্রজীবনের সঙ্গী ।সেই ছেলেবেলা থেকে একে একে সবাই চলে গেলেন।রয়ে গেলেন স্মৃতির পাতায় ।বাল্যবেলায় খুব অল্প বয়সে মাকে হারাবার পর মৃত্যু চেতনা তার নরম মনে ধীরে ধীরে বাসা বাঁধে । কিন্তু মৃত্যুর বীভত্স রূপ ধরা পরে নি বালক রবির মধ্যে ।কিন্তু বৌঠানের মৃত্যুর পর মৃত্যুর সঙ্গে তার যে পরিচয়  তা স্থায়ী  পরিচয় ।সহধর্মিণী মৃণালিনীর সঙ্গে কবির বয়সের ব্যবধান দশ বছরের-ও বেশি ।সেই মৃনালিনিও কবিকে ছেড়ে চলে গেলেন ।১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে সপ্তাহ তিনেকের জন্য রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এলাহাবাদে । ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ গাঙ্গুলীর জামাতা প্যারিলাল বন্দোপাধ্যায়ের  বাগান ঘেরা বাড়িতে ।এই সময় এই বাড়িতে একটা ছবি চোখে পড়ল । কার ছবি সেটি ? কারো কারো মতে  সেটি ছিল মৃণালিনীদেবীর । রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন অন্য সুরে অন্য ছন্দে একটি কবিতা ।বাংলা ভাষায় জন্ম নিল বলাকার ছন্দ । কবিতাটি হল  --- "তুমি কি কেবলই ছবি ?" পরে তিনি সুরারোপ করেন কবিতাটিতে ।বিখ্যাত কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ  Lyrical Ballads -এ বলেছিলেন-- " "Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings: it takes its origin from emotion recollected in tranquility ."  অর্থাৎ কবিতা হল চূড়ান্ত  অনুভূতির  এক স্বত্বঃস্ফূর্ত আবেগের   অতি-প্রকাশ । এই আবেগর উৎস হল অতীতের সঞ্চিত  শান্তিময় পরিবেশ। এই বিশেষ উক্তিকে নিজস্ব আবেগ অনুভূতির মিশ্রণের সঙ্গে বলা যায় --- যখন কোনো আবেগ বিহ্বল ঘটনা কবির সামনে ঘটে তখন তা সরাসরি কবির সৃজনশীলতায় প্রকাশ পায় না । তার জন্য প্রয়োজন সময়ের  বা space -র । সেই ঘটনা যখন অতীত হয়ে ওঠে , তখন তা হয়ে ওঠে  স্মৃতি । স্মৃতি সৃষ্টি করে সৃজনশীলতার ।রবীন্দ্র সৃজনশীলতা অনুধাবন করলে বলা যায় তিনি ছিলেন স্মৃতির পরিব্রাজক । কাদম্বরীর মৃত্যুর সদ্য মুহূর্তেই তৈরী হয় নি ---" আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে " এবং মৃণালিনীর জাগতিক প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে কবির কলমে উঠে আসেনি -- "তুমি কি কেবল-ই ছবি "।চিত্রকলা সম্পর্কে বলা যায় --- কোনো ঝর্ণার তৈলচিত্র ক্যানভাসে বন্দী কিংবা কোনো নদীর গতিপথ ক্যানভাসে আবদ্ধ । নদী এবং ঝর্ণা দুই উপাদান   জড় বস্তু হওয়া স্বত্ত্বেও জড় বা nonliving  নয় । কারণ যে বহমাণ নদীর গতিপ্রবাহ বা যে ঝর্ণার  ছান্দিক অবস্থান তা কখনই স্থির থাকতে পারে না । তাই ওই তৈলচিত্র, চোখে দেখা বাস্তব নদী ও ঝর্ণার স্মৃতির প্রসারণ বা বর্ধিত রূপ ।তুমি কি কেবলই ছবি - গানটি যেন সেই বার্তাই বহন করে । মৃণালিনীর ছবি নিছকই স্থির মুহূর্ত নয় । তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সুখ-দুঃখের স্মৃতি । রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন --- " হঠাৎ ছবিখানা দেখে মনে হল ,কী আশ্চর্য। এই কিছুদিন আগে যে আমাদের মাঝখানে এত সত্য হয়ে জীবনে এতখানি হয়ে ছিল, আজ সে কতদূরে দাড়িয়ে আছে । আমাদের জীবন ছুটে চলেছে , কিন্তু সে থেমে গেছে  ওইখানে । অর্থাৎ মৃণালিনীর  ছবির অতীত আছে । চিত্রকলাও তেমনই । শুধু ফ্রেমে বন্দী ছবি নয় । ফ্রেমের বাইরে উপচে পড়া আরও কিছু । নীরব অথচ জীবন্ত ।রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব চিত্রকলা প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্তাকারে বলা যায় কিছু কথা । রবীন্দ্র চিত্র-রীতির উদ্ভব তার পান্ডুলিপি-তে কাটাকুটির মাধ্যমে । পূরবী কাব্যগ্রন্থ রচনার সময় কাটাকুটি আঁকি-বুকি করতে করতে রবীন্দ্রনাথের পান্ডুলিপিতে ভেসে ওঠে উদ্ভট কিছু প্রাণীর ছবি । টিকটিকির সঙ্গে অন্যকোন প্রাণীর সংমিশ্রণ। মস্তিস্কটি এক প্রাণীর আর দেহাকৃতি অন্য প্রাণীর ।খানিকটা সুকুমার রায়ের হযবরল -র মত । এমন আবোল-তাবোল উদ্ভট প্রাণীর রেখাচিত্র দেখে অনেকেই মনে করেন সুকুমার রায়ের  ননসেন্স রাইমস-এর উত্স রবীন্দ্রনাথ ।কী আশ্চর্য অনিবার্য যোগসূত্র !!! সকলের অলক্ষে - অগোচরে রবীন্দ্র ভাবধারার সঙ্গে আলিঙ্গন করছে মার্কসীয় দর্শন,  আইজ্যাক নিউটনের
ভাবধারা, এমনকি সুকুমার রায়ের চিন্তা ।আবার সরাসরি রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রাণিত  হচ্ছেন বিলাতি সুর এবং স্বদেশী ভাবধারা থেকে । যে কটি বিদেশী সুরের হদিস পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি গান হোল-- পুরানো সেই দিনের কথা । বিখ্যাত স্কটিশ কবি লোকসঙ্গীত সংগ্রাহক রবার্ট বার্নস  ১৭৮৮ সালে একজন বৃদ্ধ মেষপালকের মুখে শোনেন এই গানের সুর । ১৭৯৯ সালে --- "aud lang syne " গানটি তার রচনা হিসেবে প্রকাশিত হয় । এই বহুপ্রচলিত লোকসঙ্গীত সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয় । রবীন্দ্রনাথ এই গানের সুর , কথা এবং ভাবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্টি করলেন --- পুরানো সেই দিনের কথা । আর একটি গানের কথা বলা যায় সেটি হোল ১৬১৬ সালে প্রকাশিত -- "drink  to me only " । গানটি বেনজনসনের রচনা হিসেবে পরিচিত হলেও আসলে এটি তৃতীয় শতকের গ্রীক কবি ফিলাস্তেতাস-এর letter thirty three-র আক্ষরিক রূপ ।অনেকে মনে করেন এই গানটির সুরকার  মোত্জার্ট । রবীন্দ্রনাথ এই গান থেকে রচনা করলেন --- "কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া"। বিদেশী সঙ্গীত ছাড়াও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং লোকসঙ্গীতের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিকড় ।

আপন সৃষ্টির মতো রবীন্দ্র মনের বিস্তার-ও ছিল আন্তর্জাতিক মানের।  অনুজ কবি নজরুলের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কবিগুরু । বিধাতার নিঁখুত নিয়ন্ত্রণ  -- উভয়ের জন্ম মে মাসে । ১৯১৯ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে নজরুলের লেখা প্রথম কবিতাটি প্রকাশিত হয় । কবিতা পরে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ । মুগ্ধতার রেশ কাটে না ।হয়ত সেই কারণেই "বসন্ত" নাটিকা উত্সর্গ করেন অনুজ কবি নজরুলকে ১৯২৩ সালে । তখন কবি ষাট ঊর্ধো । নজরুলের সম্পাদনায় অর্ধসাপ্তাহিক কাগজ ধুমকেতুর দ্বাদশ  সংখ্যায়  "আনন্দময়ীর আগমণে" কবিতা প্রকাশের জন্য রাজদ্রোহের অপরাধে দীর্ঘদিন কারাবরণ করতে হয় নজরুলকে । ঠিক এই সময় রবীন্দ্রনাথ তার নতুন গীতিনাট্য "বসন্ত" উত্সর্গ করেন কারারুদ্ধ    নজরুলকে ।  উত্সর্গপত্রে লেখা ছিল ---- উত্সর্গ --- শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম। স্নেহাস্পদেষু ।নজরুলের সঞ্চিতা গ্রন্থ প্রকাশ, রবীন্দ্র গ্রন্থ প্রকাশন সংস্থার বিশেষ নজরে এনে দেয় । আর ১৯৩১ সালে বিশ্বভারতী প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথের কাব্যকবিতার সংকলন--- সঞ্চয়িতা । মনে হয় এই নির্বাচনে নজরুলের সঞ্চিতা নামটির প্রভাব ছিল ।নজরুলের অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা ধুমকেতুর প্রথম প্রকাশের পর নজরুল এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে ।কবিগুরু তখন থাকতেন "দেহলি" বাড়িতে ।বাড়ি-বারান্দায় দুই কবি ।  বেতের চেয়ারে দুই প্রজন্ম মুখোমুখি ।আচমকা কবির পায়ের কাছে গিয়ে বসলেন নজরুল ।তারপর কবির পা দুটো টেনে তুলে নিলেন নিজের কোলে । কবি স্তম্ভিত ।  বোল্লেন -- ওরে ছাড়ো ছাড়ো আমার হাড়-গড় ভেঙ্গে গেল । পায়ের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ  ছিলেন স্পর্শকাতর । সর্বদাই লম্বা জোব্বা-য় তার চরণ দুটি থাকত ঢাকা ।পদসেবায় সুযোগ না পেয়ে ভারী গলায় নজরুল বল্লেন -- মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানেন ? একটা লাঠির বাড়ি মেরে আপনাকে শেষ করে দিই ।তাহলে আপনার নামের পাশে মুদ্রাক্ষরে আমার নাম একসঙ্গে ছাপা হবে । আর আপনার ছবির পাশে ছাপা হবে আমার ছবি ।একথা শুনে রবীন্দ্রনাথ রসিকতার সুরে বল্লেন --- কী সর্বনাশ !!! ওরে কে আছিস রে, শিগ্গিরি আয় !!! পাগলের অসাধ্য কিছু নেই । এমনই ছিল দুই কবির সম্পর্ক । দুজনের মধ্যে আটত্রিশ বছরের ব্যবধান থকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের ঔদার্যে সে  ব্যবধান গেছে ঘুচে । ব্যক্তি-মানস ও প্রতিভার নিরিখে এখানেই তিনি আন্তর্জাতিক । আত্মার-আত্মীয় ।আজ আমরা হাবে-ভাবে যতই বিশ্বায়নের শ্রেণীভুক্ত হই,  তবুও মন পরে থাকে রবীন্দ্রনাথে ।শ্রান্ত- ক্লান্ত দেহে যখন ঘরে ফিরি তখন তার দেখানো সেই নারীটি হয়ে ওঠে সমগ্র বাংলার প্রতিভূ ।একটা ধারণা ।আশ্বাস-ভবিষ্যত। বারংবার তার কাছে ফিরে যেতে   চাই।ফিরে পেতে  চাই একমুঠো শান্তির শয়নকক্ষ --- "পরণে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিদুর ।"