Monday, July 29, 2024

        ইস্ক্রা কলকাতার ‘ভালোবাসা তোরই নাম’ঃ সময়ের স্বরবর্ণ 

                        তন্ময় দত্তগুপ্ত


কবি গুরু ভাষায়--- ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য/হেথায় দ্রাবিড়, চীন--/শক-হূণ-দল পাঠান মোগল/এক দেহে হল লীন’।রবীন্দ্রনাথের পঙক্তি যেন এক দার্শনিক মহাসমুদ্র।জীবনের অন্তিম সময় সব কিছুই মিলিয়ে যায়।সমস্ত ধর্মের মানুষের কাছেই একমাত্র নিশ্চয়তা হলো--- মৃত্যু।মৃত্যুই সর্বভুক।সমস্ত দেহ ও মন বিলীন হয় মৃত্যুর সম্মুখে।কিন্তু স্বাধীনতার ছিয়াত্তর বছর পরেও ধর্মীয় বিভাজন বা মেরুকরণের প্রচেষ্টা হামেশাই দেখা যায়।

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশরাজ সিপাহিদের ঐক্যে ভাঙন ধরানোর জন্য চক্রান্তমূলক এক ফাঁদ তৈরী করেন।বন্দুকের কার্তুজে গরু ও শূকরের চর্বি মিশিয়ে দেন।ফলে হিন্দুরা ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য সেই কার্তুজ দাঁতে ছিঁড়বে না।আর মুসলিমরা শূকরের চর্বির জন্য সে কাজ থেকে বিরত থাকবে।আজও জাতপাতের রাজনীতি প্রবহমান।

সম্প্রতি ইস্ক্রা কলকাতা  প্রযোজিত নাটক --- ভালোবাসা তোরই অপর নাম,নাটক দেখে মনে হলো, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পরিচালক প্রণব গুহঠাকুরতা  যে ছবি একেছেন,তা এক অর্থে সদর্থক এবং আশাব্যাঞ্জক।আসলে গভীর অন্ধকার থেকেই তো বিন্দু বিন্ধু আলোর উৎসারণ।কবির ভাষায়--- ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’।নিরুপ মিত্রের রচনার মধ্যেও সময়ের শব্দ প্রস্ফুটিত।

নাটকের প্রারম্ভে দেখা যায় রামশরন মুচিকে।কাকভোর সকালে তার গৃহে আগমন ঘটে এক দাদুর।জুতো শেলাইয়ের জন্য।নানা কথোপকথনের পর দাদু বলে রামশরনের ঘরে আজ তিনবার ঈশ্বর আসবে।আরো বলে, সে আবার আসবে রাতে তার মেরামত করা জুতো নিয়ে যেতে।এরপরেই তার ঘরে আসে আলতাফ ঝাড়ুদার।হাড় হিম করা ঠান্ডায় রামশরন তাকে চা  খাওয়ায়।তাদের বাক্যালাপের মধ্যে ভেসে ওঠে সাম্প্রদায়িক বিরোধী কথা। হিন্দু হোক বা মুসলিম; মৌলবাদীরাই ধর্মীয় সন্ত্রাস করে।সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকে স্নেহ,মমতা,সহমর্মিতায়। আলতাফের প্রস্থান ঘটে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমে আসে।সে সঙ্গে বদলে যায় মঞ্চের আলো।হঠাৎ আগমন ঘটে এক ভিখারিণীর।শত ছিন্ন বস্ত্র পরা মেয়েটি রামশরনের কাছে কিছু খাবার চায়।রামশরন নিজে না খেয়ে তার ভাগের আলুসেদ্ধ ভাত দেয়।ঠাণ্ডায় নিজের পরনের চাদর দিয়ে মেয়েটির দেহ ঢেকে দেয়। হঠাৎ মঞ্চের মধ্যে প্রবেশ করে  এক তস্কর।বাইরের থেকে ভয়েস ওভারে কোরাসে শোনা যায়--- চোর চোর শব্দ।চোর কোনো পথ না পেয়ে ঢোকে রামশরনের ঘরে। সেই চোরের মুখ দেখে ভিখারিণী স্তব্ধ।একটাই স্বর ভেসে আসে ---‘তুমি!’।এক চরম ক্লাইম্যাক্সে্র মুখোমুখি দাঁড় করায় সবাইকে।জানা যায় এরা আসলে দম্পতি।অভাবের তাড়নায় উভয়েই বিচ্ছিন্ন।একজন ভিখারিনী অন্যজন তস্কর।খিদের জ্বালায় একজন খাবার চুরি করে পালিয়েছে।অন্যজন ভিক্ষা করছে দরজায় দরজায়।

 দম্পতিকে বেঁচে থাকার মন্ত্র বলে রামশরন।নতুন জীবিকার সন্ধান দেয়।যে রামশরনের ছেলে ও বৌয়ের মৃত্যু হয়েছিল সেই রামশরনের আজ ভরা সংসার।রাত ঘনিয়ে আসে।আসে সেই দাদু তার জুতো নিতে।রামশরন বলে তার বাড়িতে তো ভগবান আসেনি।দাদু বলে ,সকাল থেকে আলতাফ ঝাড়ুদার,চোর,মেয়েটি যে এসেছিল,তারাই আসলে ঈশ্বর।আসলে ঈশ্বর লুকিয়ে থাকে মানুষের মধ্যে।মানুষ তাকে খোঁজে অন্যত্র।রামশরন এক  সাধারণ মুচি।কিন্তু এই সাধারণ মুচিই এক অসীম অনন্ত চির শাশ্বত বীজ বপন করল সবার মধ্যে --- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য,তাহার উপরে নাই’।

এবার আসছি অভিনয় বিশ্লেষণে।রামশরনের ভূমিকায় অচ্যুত চক্রবর্তী অনবদ্য।তার দৈহিক গঠনের মধ্যে চারিত্রিক গুণাবলী স্পষ্ট।তার কথা বলা,বেশভূষা তাকে চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে সাহায্য করেছে।বিশেষ করে তার উচ্চারণ,স্বরক্ষেপন, বাচনভঙ্গির মধ্যে বিহারী মানুষের প্রতিচ্ছবি প্রকাশিত।আলতাফ ঝাড়ুদারের ভূমিকায় সায়ন সান্যালও বেশ ভালো। চোরের ভূমিকায় ছোটকা ভালো।কিন্তু নিম্নবিত্ত শ্রেণীর ভাষা,শব্দ,উচ্চারণ এতটা আভিজাত্য পূর্ণ না হলেই ভালো।অভাবের যন্ত্রণা আরো বেশি প্রকাশ পেলে ভালো হতো।ভিখারিণীর ভূমিকায় মধুমিতা তালুকদার দক্ষ অভিনেত্রী।কিন্তু আরো চর্চার প্রয়োজন।

নাটকের মঞ্চ ভাবনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।স্বল্প পরিসরে রামশরনের ঘর, মঞ্চের ডাউন রাইট থেকে ডাউন লেফট পর্যন্ত কাপড় দিয়ে যে জল তরঙ্গের মঞ্চমায়া নির্মিত এবং সেই সঙ্গে নৌকায় পারাপারের দৃশ্য  মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখে যেতে হয়।এক্ষেত্রে বাবলু সরকারের আলোর ভূমিকা অপরিসীম।নাট্য ভাবনার দিকে মাথায় রেখে কিছু বিষয় বলা প্রয়োজন।দাদু ওরফে অয়ন চ্যাটার্জি কি করে জানলেন এই তিনজনই এসেছিল রামশরনের বাড়িতে?এতো ডিটেলে বর্ণনা তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।নাটকে বিভিন্ন পোস্টার ব্যাবহার করা হয়েছে।সূচনায় নাটকের চরিত্রলিপি এবং শেষে পরিচালক শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লাইন উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে---মানুষ বড় কাঁদছে,/তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।এটা পোস্টারে না দেখিয়ে অন্য ভাষায় প্রকাশ পেলে ভালো হতো।শেষে এটুকুই বলার --- এই নাট্যভাবনার পাশে দাঁড়ানোর সময় এসেছে।

 

Thursday, January 25, 2024


 কেন হুব্বা?


তন্ময় দত্তগুপ্ত


১৯৮৩ সাল।তপন থিয়েটারে রমমিয়ে চলছে 'নাগপাশ' নাটক।পরিচালনা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়।বাণিজ্যিক থিয়েটারে চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর প্রথম নাটক।নাটকের মূল বিষয়--- রাজনৈতিক নেতারা কিভাবে অভাবপীড়িত যুবকদের সমাজবিরোধীতে রূপান্তরিত করে।ওই নাটকে একটা সংলাপ ছিল---' যাদের কথায় তোমরা লাশ ফেলছ,তারা কাজ ফুরালে তোমাদের লাশ সবার আগে ফেলে দেবে।  প্রকৃতপক্ষে কেউ লুম্পেন হয়ে জন্মায় না।পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে।কারোর আবার প্রবৃত্তি তাকে বিপথে চালিত করে।ব্রাত্য বসুর হুব্বা ছবি দেখে মনে হলো হুব্বা বিমলের পরিস্থিতির তুলনায় কুপ্রবৃত্তির তাড়নাই প্রবল।পরীক্ষার হলে মাস্টারমশাই তার টুকলি ধরার ফলে সে  মাস্টারমশাইয়ের  যে হাল করল তাকে প্রবৃত্তির প্রভাব ছাড়া আর কি বা বলতে পারি!এখানে গ্রীক ট্র্যাজেডি বা নেমেসিসের কোনও পরিচয় নেই।হুব্বা বিমল ওরফে শ্যামল নিয়ে মিডিয়ার চর্চা এখন তুঙ্গে।

একদিন হঠাৎ টিভির পরদায় দেখলাম হুব্বাকে।তখন লাল জমানা।একরাশ বাইকে করে হুব্বা  নমিনেশন জমা দিতে এসেছে।স্মৃতি এখনও টাটকা।আমার পরিবারের সবাই বলেছিলঃ ছি ছি।এতটা অধঃপতন?পরে হুব্বার নমিনেশন ক্যান্সেল করেছিল ইলেকশন কমিশনার।ব্যস ওইটুকুই।হুব্বাকে নিয়ে আলোচনার পদবাচ্য মনে করিনি।হুব্বা,হাত কাটা দিলীপ,কান কাটা হুলো---এদের নিয়ে উচ্চারণ মানে সময়ের অপচয়।তার মানে কি এই গ্যাংস্টারদের নিয়ে ছবি হবে না?রামগোপাল বর্মার সরকার,বা আব তক ছাপ্পন(ওনার প্রোডাকশন কোম্পানীর ছবি।)-তো গ্যাংস্টার নিয়ে ছবি।রামগোপালের প্রথম ছবি 'শিবা' নিঃসন্দেহে ট্রেণ্ড সেটার।বা যদি অগ্নিপথের বিজয় দীনানাথ চৌহানের কথা বলি; তাহলেও মনের আনাচে কানাচে একটা আবেগ বা সেন্টিমেন্ট কাজ করে।কিন্তু হুব্বা দেখে কোনও সেন্টিমেন্ট কাজ করল না।কারণ  এ চরিত্রের উল্লেখযোগ্য কোনও সুপ্রবৃত্তি  তেমন নজরেই এলো না।ব্রাত্য বসুর প্রথম ছবি "রাস্তা" দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।প্রতিটা চরিত্র  এখনও কণ্ঠস্থ।তেমনই মিঠুন রজতাভর অনবদ্য অভিনয়।তেমনই হিট ডায়লগ--- 'লাদেন লাদেন'।


  হুব্বা কেমন? তা নিয়ে হুব্বার গ্রামে যায় বাস্তবের এক টিভি সাংবাদিক।প্রত্যেকেই হুব্বার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।হুব্বা গরীবের উপকার করত।বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত।শুধু তাই নয়,খুব আস্তে আস্তে কথা বলত।সুতরাং হুগলির ত্রাস যে হুব্বা;সে কথা আবার তার গ্রামের মানুষজন বলছেন না।রিল লাইফের হুব্বা কিন্তু অনেক নৃশংস।যৌনতা যার আরেক সঙ্গী।নারীসঙ্গে যার প্রবল আসক্তি।তার মানে একথা বলার কোনও  মানেই হয় না,যে বাস্তবের হুব্বা আজ কা রবিনহুড।অপরাধী অপরাধীই।সে যে আমলের হোক।বিশেষ করে যার মজ্জায় মজ্জায় অপরাধের বিষ। 

হুব্বা সিনেমার কাহিনী বিস্তারিত বলছি না।শুধু এটুকুই বলছি;এক পুলিশ  দিবাকর হুব্বাকে ধরবার জন্য মরিয়া।কিন্তু হুব্বাকে ধরা মশকিলই নেহি না মুমকিন।বিভিন্ন আন্ডার ওয়ারল্ডের নির্ভর সিনেমার সংলাপ সে বলে।অবশেষে পুলিশের জালেই হুব্বার অন্তিম পরিণতি।যে রাজনৈতিক নেতা হুব্বাকে ব্যবহার করেছিল;সেই সোচ্চার হয়ে বলে--- আমাদের পার্টি সমাজ বিরোধীদের প্রশ্রয় দেয় না।প্রশ্ন হলো, হত্যা তো হত্যাই।

তাকে রাজনৈতিক হত্যা বললে তার স্টেটাস কি বাড়ে?যুগে যুগে এমন হত্যা রয়েছে।রাজনীতির আড়ালে যে সমাজ বিরোধীরা দাপিয়ে বেড়ায়,সে কথা আজ কাটা ঘায়ের মতো সত্য।মানুষ খুনের রাজনীতি মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। তাহলে কি সুভাষচন্দ্রের মতো সহিংস নেতারা ভুল ছিলেন? একেবারে নয়।যে দেশে শক হুণ দল পাঠান মোগল এক দেহে লীন হয়;সে দেশেই হুব্বা শ্যামল,হাতকাটা হুলো,তাজা বোমার মতো মাস্তানের জন্ম দেয় মহান নেতারা।হয়তো কদিন বাদে শুনতে হবে---তুমি আমাকে দুর্নীতি করার অধিকার দাও,আমি তোমাকে অর্থ,নিরাপত্তা সব দেবো।ব্রাত্য বসুর অরণ্যদেব নাটকের একটা সংলাপ --- অটল বিহারী কি রবীন্দ্রনাথের কনটেম্পরারি?ব্রাত্য হয়ত অনেক  এগিয়েই ভেবেছিলেন।সে সময় কি চলে এলো? সত্যি এ বড় দুঃসময়।ভয়ের ভারসাম্যহীন জীবনে আমাদের শিরদাঁড়া অজান্তেই হারিয়ে যায়। 

হুব্বা ছবিতে সৌমিক হালদারের ক্যামেরা খুবই ভালো।প্রথম শট মনমুগ্ধকর।ড্রোন ক্যামেরায় পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠা এবং হুব্বার অস্পষ্ট লাশের ভেসে বেড়ানো।হুব্বার চরিত্রে মুসারফ করিম অনেক প্রশংসা পেয়েছেন ইতিমধ্যে।এবং তার কমিক টাইমিং নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সে নিয়ে আর আলোচনা করছি না।তবে ক্লোজ শটে করিম সাহেব তার অভিব্যক্তিকে আর একটু সংযত করতে পারতেন।তাতে রিয়ালিস্টিক অভিনয় বোধহয় আরেকটু ভালো হতে পারত।আমার কেন জানি না বাস্তবের হুব্বার  দৈহিক গঠনের দিকে তাকিয়ে বার বার খরাজ মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ছিল।খরাজ এই চরিত্রে অভিনয় করলে নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতেন।সকলেই ভালো অভিনয় করেছেন।বিশেষ করে পুলিশের চরিত্রে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত।মার্জিত অভিব্যক্তি।একটা দৃশ্যের কথা উল্লেখ না করে পারছি না।হুব্বার দ্বিতীয় নারীর প্রতি আসক্তি এবং ইন্সপেক্টরের দ্বিতীয় প্রেমের প্রচ্ছন্ন আভাসের যে সেতুবন্ধন তা অনবদ্য।ছবির মুডের সঙ্গে আবহও সঙ্গীত মানানসই।


ফ্ল্যাশব্যাক এবং সমকালীন ট্রিটমেন্ট-এর ব্যাপারে কতটা পরিচালকের বক্তব্য ছিল আর কতটা সম্পাদক সংলাপ ভৌমিকের নিজস্ব সৃজনশীলতা ছিল--- সেটা এই সামান্য লেখকের পক্ষে বলা কঠিন।কারণ ছবির একটা পর্যায়ে অতীত ও সমকাল ভিন্নভাবে উপস্থাপিত।শুধু একটা বিষয় কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না।কেন নির্দিষ্ট ভাবে হুব্বা শ্যামল পরিচালক ব্রাত্য বসুর সিলেবাসে এলো?