ইস্ক্রা কলকাতার ‘ভালোবাসা তোরই নাম’ঃ সময়ের স্বরবর্ণ
তন্ময় দত্তগুপ্ত
কবি গুরু ভাষায়--- ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য/হেথায় দ্রাবিড়, চীন--/শক-হূণ-দল পাঠান মোগল/এক দেহে হল লীন’।রবীন্দ্রনাথের পঙক্তি যেন এক দার্শনিক মহাসমুদ্র।জীবনের অন্তিম সময় সব কিছুই মিলিয়ে যায়।সমস্ত ধর্মের মানুষের কাছেই একমাত্র নিশ্চয়তা হলো--- মৃত্যু।মৃত্যুই সর্বভুক।সমস্ত দেহ ও মন বিলীন হয় মৃত্যুর সম্মুখে।কিন্তু স্বাধীনতার ছিয়াত্তর বছর পরেও ধর্মীয় বিভাজন বা মেরুকরণের প্রচেষ্টা হামেশাই দেখা যায়।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশরাজ সিপাহিদের ঐক্যে ভাঙন ধরানোর জন্য চক্রান্তমূলক এক ফাঁদ তৈরী করেন।বন্দুকের কার্তুজে গরু ও শূকরের চর্বি মিশিয়ে দেন।ফলে হিন্দুরা ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য সেই কার্তুজ দাঁতে ছিঁড়বে না।আর মুসলিমরা শূকরের চর্বির জন্য সে কাজ থেকে বিরত থাকবে।আজও জাতপাতের রাজনীতি প্রবহমান।
সম্প্রতি ইস্ক্রা কলকাতা প্রযোজিত নাটক --- ভালোবাসা তোরই অপর নাম,নাটক দেখে মনে হলো, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পরিচালক প্রণব গুহঠাকুরতা যে ছবি একেছেন,তা এক অর্থে সদর্থক এবং আশাব্যাঞ্জক।আসলে গভীর অন্ধকার থেকেই তো বিন্দু বিন্ধু আলোর উৎসারণ।কবির ভাষায়--- ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’।নিরুপ মিত্রের রচনার মধ্যেও সময়ের শব্দ প্রস্ফুটিত।
নাটকের প্রারম্ভে দেখা যায় রামশরন মুচিকে।কাকভোর সকালে তার গৃহে আগমন ঘটে এক দাদুর।জুতো শেলাইয়ের জন্য।নানা কথোপকথনের পর দাদু বলে রামশরনের ঘরে আজ তিনবার ঈশ্বর আসবে।আরো বলে, সে আবার আসবে রাতে তার মেরামত করা জুতো নিয়ে যেতে।এরপরেই তার ঘরে আসে আলতাফ ঝাড়ুদার।হাড় হিম করা ঠান্ডায় রামশরন তাকে চা খাওয়ায়।তাদের বাক্যালাপের মধ্যে ভেসে ওঠে সাম্প্রদায়িক বিরোধী কথা। হিন্দু হোক বা মুসলিম; মৌলবাদীরাই ধর্মীয় সন্ত্রাস করে।সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকে স্নেহ,মমতা,সহমর্মিতায়। আলতাফের প্রস্থান ঘটে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমে আসে।সে সঙ্গে বদলে যায় মঞ্চের আলো।হঠাৎ আগমন ঘটে এক ভিখারিণীর।শত ছিন্ন বস্ত্র পরা মেয়েটি রামশরনের কাছে কিছু খাবার চায়।রামশরন নিজে না খেয়ে তার ভাগের আলুসেদ্ধ ভাত দেয়।ঠাণ্ডায় নিজের পরনের চাদর দিয়ে মেয়েটির দেহ ঢেকে দেয়। হঠাৎ মঞ্চের মধ্যে প্রবেশ করে এক তস্কর।বাইরের থেকে ভয়েস ওভারে কোরাসে শোনা যায়--- চোর চোর শব্দ।চোর কোনো পথ না পেয়ে ঢোকে রামশরনের ঘরে। সেই চোরের মুখ দেখে ভিখারিণী স্তব্ধ।একটাই স্বর ভেসে আসে ---‘তুমি!’।এক চরম ক্লাইম্যাক্সে্র মুখোমুখি দাঁড় করায় সবাইকে।জানা যায় এরা আসলে দম্পতি।অভাবের তাড়নায় উভয়েই বিচ্ছিন্ন।একজন ভিখারিনী অন্যজন তস্কর।খিদের জ্বালায় একজন খাবার চুরি করে পালিয়েছে।অন্যজন ভিক্ষা করছে দরজায় দরজায়।
দম্পতিকে বেঁচে থাকার মন্ত্র বলে রামশরন।নতুন জীবিকার সন্ধান দেয়।যে রামশরনের ছেলে ও বৌয়ের মৃত্যু হয়েছিল সেই রামশরনের আজ ভরা সংসার।রাত ঘনিয়ে আসে।আসে সেই দাদু তার জুতো নিতে।রামশরন বলে তার বাড়িতে তো ভগবান আসেনি।দাদু বলে ,সকাল থেকে আলতাফ ঝাড়ুদার,চোর,মেয়েটি যে এসেছিল,তারাই আসলে ঈশ্বর।আসলে ঈশ্বর লুকিয়ে থাকে মানুষের মধ্যে।মানুষ তাকে খোঁজে অন্যত্র।রামশরন এক সাধারণ মুচি।কিন্তু এই সাধারণ মুচিই এক অসীম অনন্ত চির শাশ্বত বীজ বপন করল সবার মধ্যে --- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য,তাহার উপরে নাই’।
এবার আসছি অভিনয় বিশ্লেষণে।রামশরনের ভূমিকায় অচ্যুত চক্রবর্তী অনবদ্য।তার দৈহিক গঠনের মধ্যে চারিত্রিক গুণাবলী স্পষ্ট।তার কথা বলা,বেশভূষা তাকে চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে সাহায্য করেছে।বিশেষ করে তার উচ্চারণ,স্বরক্ষেপন, বাচনভঙ্গির মধ্যে বিহারী মানুষের প্রতিচ্ছবি প্রকাশিত।আলতাফ ঝাড়ুদারের ভূমিকায় সায়ন সান্যালও বেশ ভালো। চোরের ভূমিকায় ছোটকা ভালো।কিন্তু নিম্নবিত্ত শ্রেণীর ভাষা,শব্দ,উচ্চারণ এতটা আভিজাত্য পূর্ণ না হলেই ভালো।অভাবের যন্ত্রণা আরো বেশি প্রকাশ পেলে ভালো হতো।ভিখারিণীর ভূমিকায় মধুমিতা তালুকদার দক্ষ অভিনেত্রী।কিন্তু আরো চর্চার প্রয়োজন।
নাটকের মঞ্চ ভাবনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।স্বল্প পরিসরে রামশরনের ঘর, মঞ্চের ডাউন রাইট থেকে ডাউন লেফট পর্যন্ত কাপড় দিয়ে যে জল তরঙ্গের মঞ্চমায়া নির্মিত এবং সেই সঙ্গে নৌকায় পারাপারের দৃশ্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখে যেতে হয়।এক্ষেত্রে বাবলু সরকারের আলোর ভূমিকা অপরিসীম।নাট্য ভাবনার দিকে মাথায় রেখে কিছু বিষয় বলা প্রয়োজন।দাদু ওরফে অয়ন চ্যাটার্জি কি করে জানলেন এই তিনজনই এসেছিল রামশরনের বাড়িতে?এতো ডিটেলে বর্ণনা তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।নাটকে বিভিন্ন পোস্টার ব্যাবহার করা হয়েছে।সূচনায় নাটকের চরিত্রলিপি এবং শেষে পরিচালক শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লাইন উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে---মানুষ বড় কাঁদছে,/তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।এটা পোস্টারে না দেখিয়ে অন্য ভাষায় প্রকাশ পেলে ভালো হতো।শেষে এটুকুই বলার --- এই নাট্যভাবনার পাশে দাঁড়ানোর সময় এসেছে।
ReplyForward |